সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা।সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিদ্রোহী কবিতা

সুকান্ত ভট্টাচার্য নিয়ে কিছু কথা

সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন বাংলা কাব্যধারায় প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন সুকান্ত। খুব অল্প সময়ের জীবনে, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে (১৩ মে ১৯৪৭) মৃত্যুবরণ করলেও, তিনি বাংলা সাহিত্যে যে গভীর ছাপ রেখে গিয়েছেন, তা আজও পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে।

সুকান্তের কবিতায় ছিল তীব্র প্রতিবাদের ভাষা, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণার কথা, এবং সমাজ পরিবর্তনের দৃঢ় আহ্বান। তাঁর লেখায় দারিদ্র্য, অনাহার, বঞ্চনা এবং শোষণের বিরুদ্ধে ছিল অকুতোভয় উচ্চারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবিতার আসল উদ্দেশ্য মানুষকে জাগিয়ে তোলা, তাঁদের অধিকার আদায়ে উৎসাহিত করা। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ "ছাড়পত্র" এ এমন অনেক কবিতা রয়েছে, যেখানে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

সুকান্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। তাঁর কবিতায় শ্রমিক, কৃষক, এবং সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা ফুটে ওঠে। একইসঙ্গে তিনি ভালোবাসা, স্বপ্ন এবং ভবিষ্যতের আশার কথাও বলেছেন। তাঁর ভাষা ছিল সহজ, সরল, এবং আবেগপূর্ণ, যা সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।

সুকান্ত ভট্টাচার্য

স্বল্পায়ু জীবনে সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য দিয়ে সমাজ বদলানো সম্ভব। আজও তাঁর কবিতা আমাদের সাহস জোগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা দেয়। সুকান্ত শুধু কবি নন, তিনি আমাদের চেতনায় জেগে থাকা এক বিপ্লবের নাম।আজকে আমরা পড়বো সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেরা কবিতা। 


ছাড়পত্র
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে

তার মুখে খবর পেলুমঃ

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।

খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত

উত্তোলিত, উদ্ভাসিত

কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বোঝে না কেউ,

কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।

পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের

পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর

অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।।


হে মহাজীবন
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়

এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,

পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক

গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!

প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-

কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,

ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ

পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি।।



বিদ্রোহের গান
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?

এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,

আমরা সবাই যে যার প্রহরী

উঠুক ডাক।


উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে

জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে

কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে

ভীরুরা থাক।


মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,

চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি

রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,

সাধ্য কার?


রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন?

এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন?

চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য

ধারি না ধার।


খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,

গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,

ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,

মৃত্যুপণ।


দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,

বসে থাকবার বেলা নেই মোটে,

রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে

পূর্বকোণ।


ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি,

বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি

খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,

কোথায় প্রাণ!


দেখব, ওপারে আজো আছে কারা,

খসাব আঘাতে আকাশের তারা,

সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,

ছড়াব দান।

জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান।।


মুক্ত বীরদের প্রতি
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর! অবাক অভ্যুদয়।

যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময়।

তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া-

আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা।

আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি!

একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী।

আমরা যে বারে বারে

তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে,

মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে,

তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উত্থানে,

উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে,

পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে

মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর

সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো।

এই সেই কলকাতা।

একদিন যার ভয়ে দুরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা।

মনে পড়ে চব্বিশে?

সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে;

হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে

পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে

গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাইঃ

রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই।

সফল! সফল! সেদিনের কলকাতা-

হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা।

জানি বিকৃত আজকের কলকাতা

বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা!


গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে-

ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান;

সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্‌খান্।

তোমারা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো।


তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার-

তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর।

পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর

ছড়িয়ে পড়বে বহুদুর-বহুদূর

তোমরা এসেছ, জেনো এইবার নির্ভয় কলকাতা-

অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা।

তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসেঃ

পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে,

মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শাখায় শাখায় লাগেঃ

হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে

অস্থির হাওয়া অরণ্যপর্বতে,

গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে।


আজ তোমাদের মুক্তিসভায় তোমদের সম্মুখে,

শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখেঃ

যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান,

আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান।

অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে

এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে।

তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে,

তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে।


তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়,

উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়।

তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার,

পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার।

আবার জ্বালাব বাতি,

হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী।।



লেনিন
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


স্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,

অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।

আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে

হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,

মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।

বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন

ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,

বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;

- আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।


সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,

কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।

বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,

দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।

দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি

আজো যায় শোনা,

দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।

পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,

লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।

আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে

লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;

ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,

যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।

অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ

অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;

দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,

অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত

বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-

এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।

লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,

অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।

মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস

মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।

লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,

বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।


রানার
- সুকান্ত ভট্টাচার্য

রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে

রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,

রানার চলেছে রানার!

রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।

দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার-

কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।


রানার! রানার!

জানা-অজানার

বোঝা আজ তার কাঁধে,

বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;

রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,

আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।

তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স'রে যায় বন,

আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ।

অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্‌মিট্ ক'রে চায়!

কেমন ক'রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!

কত গ্রাম, কত পথ যায় স'রে স'রে-

শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;

হাতে লণ্ঠন করে ঠন্‌ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো

মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো।


এমনি ক'রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,

পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে 'মেলে'।

ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে

জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।

অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,

ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।


রানার! রানার!

এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?

রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?

ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,

পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,

রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,

দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।

কত চিঠি লেখে লোকে-

কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।

এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,

এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,

এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,

এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।

দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি, -

এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-

রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব'য়ে?

কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?

রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল

আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?


রানার! গ্রামের রানার!

সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;

শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ

ভীরুতা পিছনে ফেলে-

পৌঁছে দাও এ নতুন খবর

অগ্রগতির 'মেলে',

দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-

নেই, দেরি নেই আর,

ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে

দুর্দম, হে রানার।।


অসহ্য দিন
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত

অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত।

মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত

হৃদয়গত।

ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে

দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।

এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত,

মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।


দেশলাই কাঠি
- সুকান্ত ভট্টাচার্য

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি

এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ

তবু জেনো

মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ-

বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;

আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।


মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল?

ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন-

আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!

কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,

কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ

আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।


এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে

তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?

মনে নেই? এই সেদিন-

আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;

চমকে উঠেছিলে-

আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।


আমাদের কী অসীম শক্তি

তা তো অনুভব করেছ বারংবার;

তবু কেন বোঝো না,

আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,

আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব

শহরে, গঞ্জে , গ্রামে- দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়

তা তো তোমরা জানোই!

কিন্তু তোমরা তো জানো না:

কবে আমরা জ্বলে উঠব-

সবাই শেষবারের মতো!


কনভয়
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে ছুটে গেল

যুদ্ধফেরত এক কনভয়ঃ

ক্ষেপে-ওঠা পঙ্গপালের মতো

রাজপথ সচকিত ক'রে

আগে আগে কামান উঁচিয়ে,

পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার।


ইতিহাসের ছাত্র আমি.

জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম

ইতিহাসের দিকে।

সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয়

ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে।

সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান,

পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা-

কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম,

মানুষ।

আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক

মমতা।

অনেক যুগ, অনেক অরণ্য,পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে

তারা এগিয়ে আসছে; ঝল্‌সানো কঠোর মুখে।।


কৃষকের গান
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে

এইবার ফলাব ফসল-

আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে

আজ তার নির্জন বোধন।

এ মাটির গর্ভে আজ আমি

দেখেছি আসন্ন জন্মেরা

ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ

দুর্ভিরে অন্তিম কবর।

আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি?

(গোপন একান্ত এক পণ)

এ মাটিতে জন্ম দেব আমি

অগণিত পল্টন-ফসল।

ঘনায় ভাঙন দুই চোখে

ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে;

আমার প্রতিজ্ঞা গ'ড়ে তোলে

ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি।

দুয়ারে শত্রুর হানা

মুঠিতে আমার দুঃসাহস।

কর্ষিত মাটির পথে পথে

নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।


বিক্ষোভ
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,

হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম।

জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে

ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে,

কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে

হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে?

যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী,

আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি।

ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি,

আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি,

অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা,

তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা?

বিদ্রোহী মন! আজকে ক'রো না মানা,

দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা,

দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে,

জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে।

কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল,

ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল,

ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে

মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে।

ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,

আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।।



আগ্নেয়গিরি
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ

আমি এক আগ্নেয় পাহাড়।

শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো

চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা।

এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে

আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার

আমি পাথরঃ আমি তা সহ্য করেছি।


মুখে আমার মৃদু হাসি,

বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা।

সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছিঃ

মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর,

আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী,

বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতস-বাজি–

তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা।


দেখ, দেখঃ

ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ;

দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা।

তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক,

কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত,

কিছুতেই বিশ্বাস ক’রো না–

আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর।

তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক

ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার,

অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা।


তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো,

বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন:

ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত।

উৎসব কর, উৎসব কর–

ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়,

ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর।

আর,

আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক

বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।।


আগামী
- সুকান্ত ভট্টাচার্য


জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,

আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;

মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে

মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।

যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে

তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,

বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা

শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।

আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা

উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা;

তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে,

ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে।


সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়;

শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়;

অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে

জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে।

আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে;

জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে।

ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি,

বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি।

সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে

তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে;

ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন

একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।।

Post a Comment