শিশুশ্রম
ভূমিকা:
শিশুশ্রম বর্তমান সমাজের এক জটিল ও বেদনাদায়ক বাস্তবতা। এটি এমন একটি সামাজিক ব্যাধি যা শিশুদের স্বাভাবিক শৈশব ও বিকাশকে ব্যাহত করে। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজও অনেক শিশু অল্প বয়সে পরিবারে উপার্জনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছে। শ্রমে নিযুক্ত এসব শিশু শিক্ষা, খেলা ও নিরাপদ জীবনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুশ্রম রোধ করা না গেলে একটি জাতি কখনই সুস্থ ও উন্নত হতে পারে না।
শিশুশ্রমের সংজ্ঞা ও ধরণ:
শিশুশ্রম বলতে বোঝানো হয় এমন কোনো কাজ যেখানে কোনো শিশু শারীরিক, মানসিক বা সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যার কারণে সে শিক্ষা বা স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হয়। সাধারণত ১৪ বছরের নিচে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হওয়াকে শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। শিশুশ্রম বিভিন্ন রূপে দেখা যায়—কারখানা শ্রমিক, গৃহকর্মী, রিকশা বা ভ্যানের সহকারী, চায়ের দোকানের কর্মচারী, কাঁচা বাজার বা হোটেলের কাজের ছেলে, ইটভাটার শ্রমিক, এমনকি নির্মাণ কাজেও শিশুদের দেখা যায়।
শিশুশ্রমের কারণসমূহ:
শিশুশ্রমের মূল কারণ হলো দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারের বাবা-মা অনেক সময় তাদের শিশু সন্তানদের কাজ করতে বাধ্য করে পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য। শিক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে স্কুলে পাঠাতে না পেরে কাজে পাঠিয়ে দেয়। পাশাপাশি কিছু লোভী ও অমানবিক মালিক কম মজুরিতে শিশুদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। এছাড়া সচেতনতার অভাব, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সমাজের অসাম্যও শিশুশ্রম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
শিশুশ্রমের পরিণাম:
শিশুশ্রম শিশুদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। কাজের চাপে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত পুষ্টি ও বিশ্রাম না পেয়ে অনেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মানসিকভাবে চাপে থেকে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, অনেক সময় নেশায় জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাবঞ্চিত এই শিশুরা বড় হয়ে দক্ষ নাগরিক হতে পারে না, ফলে তারা শ্রমবাজারেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা হয়ে পড়ে সীমিত। সামাজিকভাবেও তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে, যা সমাজে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।
শিশুশ্রম বন্ধে করণীয়:
শিশুশ্রম নির্মূল করতে হলে আমাদের প্রথমে দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে যাতে তারা শিশুদের কাজে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠায়। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনামূল্যে ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা উপবৃত্তি ও মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করে দরিদ্র শিশুদের স্কুলমুখী করা যেতে পারে।
শিশুশ্রমবিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যারা শিশুদের দিয়ে কাজ করায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে শিশুদের অধিকার ও ক্ষতির বিষয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম, এনজিও এবং সমাজের সচেতন নাগরিকদের এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও বাংলাদেশ:
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা শিশুশ্রম নিরসনে কাজ করছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে (UNCRC) শিশুদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও ২০১০ সালে ‘শিশু আইন’ পাশ করে, যেখানে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ। যদিও আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কিছু এনজিও যেমন—বন্ধন, ব্র্যাক, আশা, সেভ দ্য চিলড্রেন ইত্যাদি সংস্থা শিশুশ্রম প্রতিরোধে কাজ করছে। তারা শিক্ষা, পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত হওয়া দরকার।
সমাজের ভূমিকা:
শিশুশ্রম বন্ধে সমাজের প্রতিটি মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শিশুদের যদি কোথাও শ্রমে নিয়োজিত দেখতে পাই, তাহলে সেটি প্রতিবাদ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। গৃহস্থালী কাজে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে শিশুদের ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেক পরিবার, বিদ্যালয়, মসজিদ-মন্দির, ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে শিশুদের শিক্ষায় উৎসাহিত করতে হবে।
শিক্ষকরা শিশুদের কাছে শুধু জ্ঞানের দাতা নয়, বরং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তারা যদি সমাজে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন, তাহলে শিশুশ্রম অনেকটাই কমে আসবে। শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্কুল পর্যায়ে নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে।
উপসংহার:
শিশুশ্রম সমাজ ও দেশের জন্য একটি অভিশাপ। একটি শিশুর শৈশব কখনোই ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই আজকের শিশুদের রক্ষা করতে না পারলে আগামীর বাংলাদেশ কখনোই সমৃদ্ধ ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। শিশুশ্রম নির্মূল করতে হলে সরকার, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একটি শিশুও যেন কলকারখানায় নয়, বরং শ্রেণিকক্ষে, খেলাধুলার মাঠে ও আনন্দময় শৈশবে দিন কাটায়—এটাই হওয়া উচিত আমাদের সকলের লক্ষ্য।