গল্পের নাম: "শেষ বিকেলের প্রতীক্ষা"
বিকেলটা একটু অন্যরকম ছিল। আকাশে হালকা মেঘের ভেলা, রোদ ঝাপসা হয়ে পড়েছে। এমন দিনে নিশাতের মন কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। আজও হলো তাই। কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দূরের নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। হালকা বাতাসে চুলগুলো ওড়ে, আর তার মনে পড়ে যায় অনির কথা।
আনির সঙ্গে নিশাতের পরিচয় হয়েছিল ঠিক এই সময়ে, প্রায় তিন বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে লাইব্রেরির কোণায় পড়তে পড়তেই শুরু হয়েছিল তাদের আলাপ। অনি ছিল বরাবরই একটু চুপচাপ, ভদ্র, আর গভীর চোখের অধিকারী। যেন সে চোখের ভিতর শত গল্প লুকিয়ে আছে। নিশাত ছিল ঠিক তার বিপরীত — প্রাণবন্ত, চঞ্চল আর প্রশ্নে ভরা।
প্রথমদিন লাইব্রেরিতে বই খুঁজতে গিয়ে দু’জনের চোখাচোখি। নিশাতের হাতে ছিল 'নির্জন দ্বীপের প্রেম' — বইটা দেখে অনি মুচকি হেসেছিল। নিশাত বিরক্ত হয়ে বলেছিল,
— "কী হলো? হাসলেন কেন?"
অনি শান্ত গলায় বলেছিল,
— "এই বইটা পড়লে মনে হবে, ভালোবাসা হয়তো নির্জনতা থেকেই জন্ম নেয়।"
সে উত্তরে নিশাতের চোখে কৌতূহল জাগে। কথার মধ্যে এমন গভীরতা সে সচরাচর খুঁজে পায় না। সে আর দেরি না করে টেবিলেই বসে পড়েছিল, অনির ঠিক পাশের চেয়ারে।
সেই একসাথে পড়াশোনা করার দিনগুলো কেমন করে যে গভীর বন্ধুত্বে আর তারপর প্রেমে পরিণত হলো, তা বুঝতেই পারেনি তারা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিনের আড্ডা, বিকেলের ক্যাম্পাস হেঁটে বেড়ানো, লাইব্রেরিতে একসাথে বই পড়া — সবকিছুতেই যেন তাদের গল্প জড়িয়ে পড়েছিল।
তবে ভালোবাসার গল্প কি আর সবসময় সহজ হয়?
ডিগ্রি শেষ হতেই অনির জন্য চলে আসে একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ। স্বপ্ন পূরণের পথে বড় সুযোগ। অনি প্রথমে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। নিশাত বুঝতে পারছিল অনির মনের টানাপোড়েন। সে নিজে থেকেই বলেছিল,
— "তুমি যেও অনি। তোমার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাও। আমি এখানে থাকবো। অপেক্ষা করবো।"
অনি কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু নিশাতের চোখের দৃঢ়তায় থেমে গিয়েছিল সে। বিদায়ের দিন নিশাত অনিকে বলে দিয়েছিল,
— "শেষ বিকেলে ফিরো। আমি থাকবো ঠিক এই বারান্দায়। আমাদের গল্পটা এখানেই শেষ হবে না।"
বিদেশ চলে যাওয়ার পর অনি আর নিশাতের যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। তবে সময়ের ব্যবধান আর দূরত্বের কারণে কথাগুলো যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে শুরু করেছিল। নিশাত বুঝতে পারছিল, অনির ব্যস্ততা তাকে গ্রাস করছে। তবুও সে অপেক্ষা করত। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত, যেন অনির পাঠানো কোনো চিঠি কিংবা মেসেজ ঠিক তখনই এসে পৌঁছাবে।
দিন গড়িয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর। অনির কাছ থেকে যোগাযোগ কমে এলো। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে পেল অনি নাকি নতুন পরিবেশে বেশ ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছে। কখনো কখনো নিশাতের মন খারাপ হয়ে যেত, তবে সে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিত —
“ভালোবাসা মানে তো শুধু পাওয়া নয়, অপেক্ষাও একটা গভীর ভালোবাসা।”
একদিন সন্ধ্যায় নিশাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, বাড়ির সামনের রাস্তায় একজন অপরিচিত তরুণ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটি চিঠি। সে এগিয়ে এলো নিশাতের দিকে।
— "আপনার জন্য একটি চিঠি।"
চিঠি হাতে নিয়ে নিশাতের হাত কেঁপে উঠল। পরিচিত হাতের লেখা — অনির! উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করতে লাগল। চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল সে।
"প্রিয় নিশাত,
সময়ের ব্যবধান আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে ঠিকই, তবে তোমার স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্যও আমার মন থেকে মুছে যায়নি। ব্যস্ততার ভীড়েও তোমার কথা ভেবেছি প্রতিদিন। বিশ্বাস করো নিশাত, এই দূরত্ব আমাকে বুঝিয়েছে, তুমি আমার জীবনের ঠিক সেই জায়গায় আছো যেখানে আমার সমস্ত গল্প শুরু হয়। আর আমি চাই, সেই জায়গাতেই আমার গল্পের শেষ অধ্যায়টা শুরু হোক।
আমি ফিরছি। ঠিক তোমার দেওয়া প্রতিশ্রুতির মতো, শেষ বিকেলে। অপেক্ষা করো।
— অনি"
চিঠি পড়ে নিশাতের চোখ ভিজে উঠল আনন্দের অশ্রুতে। সে বারান্দার দিকে তাকাল। শেষ বিকেলের আলো তখন নরম হয়ে এসেছে। বাতাসে এক অদ্ভুত শান্তি। মনে হলো, প্রকৃতিও যেন অপেক্ষা করছে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত পুনর্মিলনের জন্য।
কয়েকদিন পরের কথা। ঠিক বিকেলের আলো নিভে যাওয়ার মুহূর্তে বাড়ির সামনের গেট খুলে গেল। অনি দাঁড়িয়ে আছে, মুখে সেই চিরচেনা শান্ত হাসি। চোখে ক্লান্তি থাকলেও সেখানে ছিল গভীর ভালোবাসার দীপ্তি। নিশাত ছুটে গেল অনির দিকে। তাদের চোখে চোখ পড়ল, আর কোনো শব্দের প্রয়োজন হলো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পুরোনো দিনগুলোর মতোই, যেন সময় থেমে গেছে। শুধু হৃদয়ের বাঁধন আরও শক্ত হয়েছে। অনি বলল,
— "তুমি তো বলেছিলে, শেষ বিকেলে ফিরতে। আমি এসেছি, ঠিক সময়ে।"
নিশাত হাসল, চোখের কোণে জল ঝিকমিক করল।
— "জানি। আমি জানতাম তুমি আসবে। ভালোবাসা কখনো পথ ভুল করে না।"
সন্ধ্যার নরম আলোয় তাদের দু’জনের ছায়া মিশে গেল এক হয়ে। যেন পুরোনো গল্পের নতুন অধ্যায়ের শুরু।
গল্পের নাম: "আরো একটি দিন"
শহরটা ব্যস্ত, শোরগোলভরা। গাড়ির হর্ণ, মানুষের হাঁটাচলা, দোকানের কোলাহল — এসবের মাঝে তৃষা প্রায়ই নিজের মতো হারিয়ে যায়। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, অথচ প্রতিদিনের মতোই তার চোখ ছাদবাগানের দিকে যায়। সন্ধ্যার আলো নিভতে নিভতে, সে গাছের পাতার ফাঁক গলে আকাশের দিকে তাকায়, মন খুঁজে ফেরে একটুখানি প্রশান্তি।
সেই প্রশান্তি সে প্রথম খুঁজে পেয়েছিল শুভ্রর পাশে। দু'বছর আগে, এই ছাদেই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের। তৃষা তখন সদ্য ভাড়া নিয়েছিল এই বাসাটা, আর শুভ্র ছিল পুরোনো ভাড়াটিয়া। এক সন্ধ্যায় ছাদে হালকা বৃষ্টির পর তৃষা ফুলগাছগুলোর জল ঝেড়ে দিচ্ছিল, তখনই শুভ্র এগিয়ে এসে বলেছিল—
— "আপনার গাছগুলো যেন বৃষ্টিতেও হাসছে।"
তৃষা চমকে তাকিয়ে ছিল। এমন কথা কেউ কখনও বলেনি তাকে। তারপর কথায় কথায় জানা গেল, শুভ্র সাহিত্যের ছাত্র, কবিতা লেখে। আর তৃষা? সে পড়ে হিসাববিজ্ঞানে, কঠিন সূত্র আর সংখ্যার জটিল খেলায় ডুবে থাকে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় তারা বুঝেছিল, সংখ্যা আর শব্দ — আলাদা জগতের হলেও এক ছাদের নিচে খুব সহজে মিশে যায়।
সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা, দিন পেরিয়ে রাত, তাদের কথাবার্তা বাড়তে লাগল। শুভ্র প্রায়ই তৃষাকে নতুন লেখা কবিতা শোনাত। তৃষা হাসত, বলত —
— "তোমার কবিতায় তো ভালোবাসার ছায়া দেখি!"
শুভ্র মৃদু হেসে উত্তর দিত —
— "কার ছায়া, বলো?"
তৃষা কোনোদিন স্পষ্ট করে উত্তর দেয়নি। কিন্তু শুভ্রর চোখে তাকিয়ে সে বুঝত, উত্তর না বললেও শুভ্র জেনে গেছে।
একসঙ্গে ছাদে বসে চা খাওয়া, বৃষ্টির সময় গাছের পাতায় জমা জলের ফোঁটায় খেলা করা, কিংবা সন্ধ্যার আলোয় একসঙ্গে নীরবে আকাশ দেখা — তাদের সম্পর্কটা ছিল ঠিক এমন নীরব অথচ গভীর। শহরের কোলাহলে নিঃশব্দে গড়ে ওঠা বন্ধন।
তবে সময় সবসময় সমান থাকে না। শুভ্র হঠাৎ করেই চাকরির খোঁজে অন্য শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তৃষা কিছু বলল না, বলার মতো সাহসও পেল না। বিদায়ের দিন শুভ্র বলেছিল—
— "যদি পারো, আরেকটা দিন অপেক্ষা করো। আমি ফিরে আসবো।"
তৃষা শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েছিল। বুকের ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠেছিল, কিন্তু সে কিছুই প্রকাশ করেনি। শুভ্র চলে গেল। শহরটা যেন আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠল, আর তৃষার দিনগুলো নিঃশব্দ আর একঘেয়ে হয়ে গেল।
প্রথমদিকে শুভ্রর মেসেজ আসত, কবিতার কয়েকটা লাইন, কিংবা হঠাৎ করে ফোন দিয়ে বলত —
— "তোমার গাছগুলো কেমন আছে?"
তৃষা হেসে বলত —
— "তোমার অপেক্ষায়।"
কিন্তু ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে এলো। শুভ্র ব্যস্ত হয়ে পড়ল নতুন শহরে, নতুন জীবনে। তৃষার মন মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত — শুভ্র কি কথা রেখেছে? সে কি এখনো তৃষার ছাদের ফুলেদের কথা মনে রাখে?
তৃষা তবুও থামেনি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদে ওঠে, গাছগুলোর যত্ন নেয়, শুভ্রর জন্য আরেকটা দিন অপেক্ষা করে। দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরিয়ে যায়। আশপাশের লোকজন পর্যন্ত খেয়াল করে —
— "আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?"
তৃষা শুধু হেসে বলে —
— "হয়তো। হয়তো অপেক্ষা করছি।"
একদিন, ঠিক বর্ষার শেষ বিকেলে, হঠাৎ করেই ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা তৃষার কানে ভেসে আসে পরিচিত কণ্ঠস্বর —
— "তোমার গাছগুলো তো এখনও হাসছে!"
চমকে উঠে পিছনে তাকাল তৃষা। শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে, ভিজে কাপড়ে, মুখে পুরনো সেই হাসি। চোখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও গভীর ভালোবাসা অটুট।
তৃষার চোখ ছলছলিয়ে উঠল। শুভ্র এগিয়ে এসে বলল —
— "আরেকটা দিন অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, তুমি তো এতোদিন অপেক্ষা করেছো!"
তৃষা মৃদু হেসে উত্তর দিল —
— "ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু অপেক্ষাটাই তো ভালোবাসার আরেক রূপ।"
শুভ্র তার হাত ধরল। ছাদের গাছেরা যেন আনন্দে দুলে উঠল। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়ল তাদের ওপর। তৃষা বুঝতে পারল, অপেক্ষার মূল্য সে পেয়েছে। শুভ্র ফিরে এসেছে, তাদের গল্পের নতুন অধ্যায় লিখতে।
গোধূলির আলোয় ছাদজুড়ে যেন এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। শুভ্র বলল —
— "তৃষা, আরেকটা দিন নয়, এবার সারাজীবন অপেক্ষা করো আমার জন্য।"
তৃষা চোখের জল গোপন করতে করতে হাসল।
— "এবার আর অপেক্ষা নয়, এবার চল একসঙ্গে হাঁটি।"
ছাদের ফুলেরা ঝিরঝিরে হাওয়ায় নেচে উঠল, যেন তারা এই পুনর্মিলন উদযাপন করছে। শহরের ব্যস্ততা তখনও চলছিল, কিন্তু তৃষা আর শুভ্রর জন্য যেন সময় থমকে গিয়েছিল। তাদের ভালোবাসা জয় করেছে সময়ের সব প্রতীক্ষা।
শেষ।