বেগম রোকেয়া: নারী জাগরণের অগ্রদূত
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সমাজে নারী মুক্তি আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় নক্ষত্র। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাব্রতী, লেখিকা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত যোদ্ধা। তৎকালীন সমাজে যখন নারীরা ছিল অবরুদ্ধ, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ও অধিকারহীন, তখন বেগম রোকেয়া মুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার জীবন ও কর্ম নারীর মর্যাদা, শিক্ষা ও স্বাধীনতার এক অমলিন দৃষ্টান্ত।
জন্ম ও পারিবারিক পরিবেশ
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তার পিতার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। তিনি ছিলেন একটি ধর্মভীরু অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী নারী, যেখানে নারীর শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধপ্রায়। পরিবার ও সমাজের রক্ষণশীলতার মধ্যে থেকেও তিনি শিক্ষার আলো গ্রহণ করেন তার প্রগতিশীল ভাই ইব্রাহিম সাবেরের উৎসাহে।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত
বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজের অগ্রগতির জন্য নারীর শিক্ষা অত্যাবশ্যক। নারী শিক্ষা ছাড়া সমাজের উন্নয়ন অসম্ভব — এই চিন্তা থেকেই তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, যা সে সময়ে মুসলিম সমাজের নারীদের জন্য ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শুরুতে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হলেও তার নিরলস পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে এই বিদ্যালয় নারী শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
সাহিত্যকর্ম ও চিন্তাধারা
বেগম রোকেয়া ছিলেন প্রতিভাবান লেখিকা। তিনি বিশ্বাস করতেন, কলমের শক্তি বন্দি মনকে মুক্ত করতে পারে। তার ইংরেজি রচিত গল্প ‘Sultana's Dream’ (সুলতানার স্বপ্ন) নারীর স্বাধীনতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের স্বপ্নময় চিত্র তুলে ধরেছে। এখানে তিনি এমন এক সমাজের কল্পনা করেছেন, যেখানে নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং পুরুষেরা গৃহবন্দি। এ গল্প নারীর ক্ষমতায়নের এক সাহসী অভিব্যক্তি।
তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘আবরণ রচনা’, যেখানে তিনি পর্দা প্রথার কুফল এবং নারীর প্রগতি রোধকারী সামাজিক ব্যাধিগুলো সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেন। তার লেখার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস নারীর অধিকার হরণ করে।
সমাজ সংস্কারক হিসেবে অবদান
বেগম রোকেয়া শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারকও। তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন, এবং নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি নারীকে কেবল গৃহিণী নয়, সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তার মতে, "নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করার কোন যুক্তি নেই; তারা একে অপরের পরিপূরক।"
তিনি নারীদের মধ্যে আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস এবং জাগরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তার অনুপ্রেরণায় অনেক নারী শিক্ষার পথে এগিয়ে আসে এবং সামাজিক অবরোধ ভেঙে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের সাহস পায়।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
নারী জাগরণের এই অগ্রদূত ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, তারই জন্মদিনে, মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরেও তার আদর্শ ও কর্ম আজও প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশ সরকার তার সম্মানে প্রতি বছর ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ পালন করে থাকে। এই দিন নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য নারীদের পুরস্কৃত করা হয়।
মূল্যায়ন
বেগম রোকেয়া আজও নারী মুক্তি আন্দোলনের আলোকবর্তিকা। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেদ করেই নারী তার প্রকৃত মর্যাদা লাভ করতে পারে। তার সাহসী কলম আর অবিচল কর্মপ্রচেষ্টায় নারী জাগরণের যে দীপ জ্বলে উঠেছিল, তা আজও দীপ্তিমান। তিনি ছিলেন শিক্ষা ও মানবতার পক্ষে, কুসংস্কার ও অবিচারের বিরুদ্ধে।
উপসংহার
বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। আজকের সমাজে নারীর যে অগ্রগতি, তার পেছনে রোকেয়ার অপরিসীম ত্যাগ, সাধনা এবং প্রেরণা কাজ করেছে। তার স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজ, যেখানে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদায়, স্বাধীনতায় এবং সম্মানে বসবাস করবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আজও আমাদের নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে। বেগম রোকেয়া কেবল অতীতের এক কিংবদন্তি নন, তিনি ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শকও।