আমাদের এই দেশ রচনা class 5,6,7,8,9,10

আমাদের দেশ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মেলবন্ধন আমাদের দেশ, বাংলাদেশ। এদেশের প্রকৃতি, আবহাওয়া, নদ-নদী, পাহাড়, সবুজ শ্যামল ভূমি এবং পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী একে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের জাতির গর্ব ও চেতনার মূল ভিত্তি। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, পরিশ্রমী ও অতিথিপরায়ণ। কৃষি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলাসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিচিতি

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এর উত্তরে ভারত, পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার, পশ্চিমে ভারত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশ একটি নদীবাহিত দেশ এবং এখানকার প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা উল্লেখযোগ্য। এসব নদ-নদী কৃষিকাজ ও জলপরিবহনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


প্রকৃতি ও জলবায়ু

বাংলাদেশের প্রকৃতি অত্যন্ত মনোরম। ছয়টি ঋতুর আবর্তনে এখানকার আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত— এই ছয় ঋতু আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জীবনধারায় বিশাল ভূমিকা রাখে। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম পড়ে এবং ফলের সমারোহ দেখা যায়। বর্ষাকালে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, নদ-নদী ভরে ওঠে। শরৎ ও হেমন্তে মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করে এবং শীতকালে প্রকৃতি শুষ্ক ও শীতল হয়ে ওঠে। বসন্ত ঋতু সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির রূপে নতুন প্রাণ এনে দেয়।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবময় ও সংগ্রামী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত অঞ্চলটি দীর্ঘ ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের অধীনে ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতির আত্মপরিচয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এরপর ক্রমান্বয়ে স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার হয়, যা culminate হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর হামলা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। এ মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করি।

অর্থনীতি ও কৃষি

বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। এদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। ধান, গম, পাট, আখ, চা, সরিষা ইত্যাদি প্রধান ফসল। বাংলাদেশ একসময় "সোনালি আঁশের দেশ" নামে পরিচিত ছিল, কারণ পাট ছিল অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি খাত, মৎস্য ও চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ও দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন— শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ ও ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার, শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাউল গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, পালাগান, যাত্রাপালা, লোকসংগীত ইত্যাদি আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ। পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, ঈদ, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন প্রভৃতি উৎসব এখানে নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য তৈরি করে।

খেলা ও বিনোদন

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেট এবং ফুটবল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে ক্রিকেটে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় এবং ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা লাভ করে। এছাড়া হকি, কাবাডি, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদিও জনপ্রিয় খেলা।

বিনোদনের জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। নাটক, সিনেমা, সংগীত, লোকজ সংস্কৃতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল কন্টেন্ট বর্তমানে মানুষের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস। এছাড়া সিলেটের চা বাগান, বান্দরবানের পাহাড়, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁর ঐতিহাসিক স্থাপত্যসহ অসংখ্য স্থান পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের রয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনা, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্নীতি, জনসংখ্যার চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী ভাঙন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষার প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবেশবান্ধব নীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আরো উজ্জ্বল করতে পারে।

উপসংহার

বাংলাদেশ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এদেশের মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। আমাদের উচিত দেশের প্রতি ভালোবাসা বজায় রেখে দেশের উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ একদিন উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

Post a Comment