একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে গল্প।ভাষা শহীদদের নিয়ে গল্প।একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে ছোট গল্প

একুশের গল্প

আনিকা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনের কথা সে বইয়ে পড়েছে। সে জানে এই দিনটি শুধু শহীদ দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সারা বিশ্বে পালন করা হয়।


একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। এই দিন খুব সকালে সব বয়সের লোকেরা শহীদমিনারে যায় ফুল দিতে। খুব ছোটবেলায় সে তার বাবার সাথে একবার শহীদমিনারে গিয়েছিল ফুল দিতে। তাছাড়া প্রতিবছর সে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে টেলিভিশনে নানা অনুষ্ঠান দেখে থাকে। শহীদমিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্যও সে খুব মজা করে দেখে। তার বাবা এবার আনিকাকে শহীদমিনারে নিয়ে যাবেন ফুল দিতে। তাই সে মনে মনে ভীষণ খুশি। সে অপেক্ষা করছে, কবে সেই শহীদদিবস আসবে তার জন্য।

একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে আনিকার বাবা বেশকিছু ফুল কিনে এনেছেন। তার মা সেই ফুল দিয়ে একটি মালা তৈরি করেছেন। আগামীকাল খুব সকালে তারা এই মালাটি নিয়ে শহীদমিনারে যাবে। আনিকা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। বাবার সঙ্গে সে ফুলের মালা নিয়ে যাচ্ছে শহীদমিনারে। আনিকাদের মতো অনেকেই ফুল এবং ফুলের মালা হাতে নিয়ে শহীদমিনারে যাচ্ছে। শহীদমিনারে ফুল দিতে পেরে আনিকা ভীষণ খুশি।

একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আনিকার অনেক কিছু জানার কৌতূহল। সে তার বাবার কাছে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানতে চায়। সে জানতে চায় ভাষা আন্দোলন কেন হয়েছিল, কীভাবে আন্দোলন হয়েছিল, আন্দোলনে কতজন শহিদ হয়েছিল, তাদের পরিচয় কী ছিল ইত্যাদি। তার বাবা একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।


আনিকার বাবা তাকে বললেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা ছিল তাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। নানান অপকৌশলে তারা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করত। তারা এই শোষণের কাজকে দীর্ঘ করার জন্য বেশকিছু পথ বেছে নেয়। তার মধ্যে একটি হলো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা। অথচ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয় সেটাই ছিল ভাষা আন্দোলন। একুশের চেতনাই বাঙালি জাতিকে দিয়েছে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের প্রেরণা।

ভাষাবাংলা আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা। এই ভাষাকে রক্ষা করার জন্য সেই সময় ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাধারণ মানুষসহ পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। তাদের অনেকের লাশ গুম করে ফেলার কারণে খুঁজে পাওয়া যায়নি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ৫-৬ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হলেন আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান।


শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ বাবার সঙ্গে প্রেস পরিচালনায় যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার পারিল (বতর্মানে যার নামকরণ হয়েছে রফিকনগর) গ্রামে। শহীদ আবুল বরকত ভারতীয় উপমহাদেশের (অবিভক্ত) মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসা করানোর জন্য ময়মনসিংহ হতে ঢাকাতে আসেন শহিদ আবদুল জব্বার। গ্রামে তিনি দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ছোটখাটো একটি দোকান দিয়ে ব্যবসা করতেন। শহীদ শফিউর রহমান ঢাকায় হাইকোর্টে করনিক পদে চাকরি করতেন। তার বাড়ি ছিল অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের হুগলি জেলার কোন্নগর গ্রামে। শহিদ আবদুস সালাম ৮৫ দিলকুশাস্থ ‘ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এ করনিক পদে চাকরি করতেন। তার বাড়ি ছিল ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষ্মণপুর গ্রামে। একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় রয়েছে একজন নয় বছরের বালক, যার নাম অহিউল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল নামে একজন রিকশাচালক। ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলিতে তারা নিহত হন।


আনিকার বাবা আরো বললেন, সারা বিশ্বের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এখন চেষ্টা করা হচ্ছে। মাতৃভাষার গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য বর্তমানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমাদের উচিত মাতৃভাষাকে সম্মান করা। মাতৃভাষাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে বাংলাভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা সবসময় চেষ্টা করব সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করতে।


ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আনিকা বাবার মুখ থেকে অনেক কিছু শুনেছে। এসব কথা শুনে ভাষাশহীদদের প্রতি তার মন শ্রদ্ধায় ভরে যায়। আনিকা তার বাবাকে অজান্তেই প্রশ্ন করে বসল। বাবা, তুমি কেন আমাকে ইংরাজি ভাষা ভালোভাবে শেখার জন্য বকাবকি কর? আমি তো এখনো বাংলাভাষা ভালোভাবে শিখতে পারিনি। আর তুমি তো কথা বলার সময় শুধু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কর। আনিকার বাবা এ রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন তা সে ভাবতেও পারেননি। মেয়ের এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাবা চুপ থাকলেন।


২.একুশের বিশেষ ছোট গল্প, 'প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল পেরিয়ে'

উৎসর্গ - যুদ্ধ অপরাধীদের ফাসির দাবিতে আন্দোলনরত সকল সৈনিক।


সৌরভ সাহেবের মনটা আজ ভীষন খারাপ। বিছানায় অনেক এদিক সেদিক করেও শেষ পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে পারলেন না। অথচ শোবার আধা ঘন্ঠা আগে তিনি বেশ কয়একটি ডাইজিপাম খেয়ে বিছানায় গিয়েছিলেন।


চিৎ হয়ে শোয়া অবস্থায় বিছানার বাম পাশটির ফাঁকা জায়গাটিতে হাত পড়তেই তিনি চমকে উঠলেন, একটু সামলে উঠতেই মনে পড়ল রুপা প্রায় ছ‍‍‌’মাস তার সাথে এক ঘরে থাকেনা।

যদিও তার সাথে এক ঘরে না থাকার ব্যাপারে তিনি কোন কারন খুজে পাননি। রুপা শুধু একদিন বলেছিল-

-এ রকম একজন গ্রাম্য ক্ষাত লোকের সাথে এক বিছানায় শুতে আমার শরীর ঘিনঘিন করে ।


সেদিন তিনি শুয়ে শুয়ে একটা ফান ম্যাগাজিনে ডুবে ছিলেন। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন রাত এগারটা বাজে। ঘড়ি দেখে তিনি আবারো পড়াই মনযোগ দিলেন। ব্যাপারটি তাকে সেদিন খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি কারন তিনি জানতেন রুপা এই কাজটি একদিন করবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ম্যাগাজিনটি পড়তে পড়তে তিনি আশ্চর্য ভাবে লক্ষ করলেন যে ফান ম্যাজিন পড়ে তিনি বিরক্ত বোধ করছিলেন সেটি পড়ে তার অকারনে হাসি আসছে, সে রাতে তার ঘুমও খুব ভাল হল। পরদিন নাস্তার টেবিলে জব্বারের মাকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, রুপা খুব সকালেই নাস্তা করে বের হয়ে গেছে। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে টুকটাক কিছু মুখে দিয়ে তিনি উঠে পড়লেন। নিজের রুমে এসে একটা সিগেরেট জ্বেলে মনে মনে ভাবলেন, কি এমন কাজ যে প্রতিদিন এত সকালে তাকে বাসা থেকে বেরুতে হবে, আবার ফিরবেতো সেই রাত দশটায় ! তাকে দেবার মত কোন সময় রুপার নেয়, এতে অবশ্য সৌরভ সাহেবের কোন অভিযোগ বা ক্ষোব নেয় বা এ নিয়ে কখনো কোন অনুযোগও তুলেননি রুপার কাছে। কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ে এশা.........।

স্ট্যান্ডার্ড ফাইভে পড়ে এশা, এই বয়সে সে তার মাকে অনুকরন করা শিখে গেছে খুব ভালোভাবেই। বাড়িতে যতক্ষন থাকবে শুধু সাজগোজ আর মিউজিক সিসটেমে হাই ভল্যিয়মে গান শোনা। এ নিয়েও সৌরভ সাহেব কোন দিন রুপার সাথে কথা বলেননি কারন জানতেন বলে লাভ হবেনা। রুপা অনেকটা জোর করেই তাকে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। সৌরভ সাহেব মাঝে মধ্যে এয়ো এখেন রুপা প্রায়ই গাদা গাদা প্রশাধন সামুগ্রী, সিডি এই সব মেয়েকে এনে দিচ্ছে। তিনি শুধু এ সব দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। উনি খুব ভালরেই জানেন বলে কোন লাভ হবে না বরং রাতের বেলা চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ির সব কাজের লোকদের কাছে তাকে আবারো হাসির পাত্র হিসেবে তুলে ধরবে। তার বারো বছরের মেয়েটা এই বয়সে আস্তে আস্তে বিপথে যাচ্ছে অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। এই ভাবনাটা ইদানিং তাকে কুরে কুরে খায়।

এই সব ব্যাপার নিয়ে একদিন রুপাকে বলতেই সে ধেই ধেই করে রেগে উঠে,

-মেয়ে কি তোমার একার ? মেয়ের জন্য মায়া কান্না দেখাতে এসনা বলে দিলাম। মেয়ে আমার আমি বুঝব কিসে ওর মঙ্গল আর কিসে অমঙ্গল হয়। নিশ্চয় কোন ক্ষ্যাতের কথায় ওকে ক্ষ্যাত হিসেবে বেড়ে উঠতে অন্তত মা হিসেবে আমি তা করতে দিতে পারিনা !

ঢং ঢং করে পুরোন দেয়াল ঘড়িটা বারো বার বেজে জানিয়ে দিল রাত এখন বারোটা। সৌরব সাহেব শুয়ে শুয়ে বাচ্চাদের মত এক দুই তিন এভাবে ঘড়ির ঘন্ঠার শব্দ গুনলেন। বারোটা শেষ হলে তিনি বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। সিগেরেটের প্যাকেট, লাইটার এবং ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি নিয়ে বেলকুনিতে আসলেন। রকিং চেয়ারটা এক কোনে রাখা আছে, ওটাকে টেনে ব্যালকুনির মধ্যেখানে নিয়ে এলেন, রুমে গিয়ে একটা সাইড টেবিল এনে চেয়ারের পাশে রেখে তার উপর সিগেরেটের প্যাকেট, লাইটার ও পানির বোতলটি সাজিয়ে রাখলেন। চেয়ারে বসে সামনে গ্রিলের বাইরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। শহরের এদিকটা অনেকটা নির্জন। অভিজাত এই আবাসিক এলাকার জমির আকাশ ছোঁয়া দামের কারনে আশপাশে বাড়ি ঘর তেমন একটা হয়নি, সৌরভ সাহেবের ডান দিকের প্লটটি এখনো ফাঁকাই পড়ে আছে বামদিকে একটা ছয় তলা বাড়ি হয়েছে এছাড়া তার বাড়ির সামনে একটা হাই রাইজ বিল্ডিং অনেকটা দৈত্য দৈত্য ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সৌরভ সাহেব অত্যান্ত দক্ষ হাতে একটা সিগেরেট জ্বাললেন। সামনের দিকে চেয়ে কিছুটা অবাক হলেন তিনি,


এত উঁচু একটা বিল্ডিং অথচ কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। অল্প কয়েকটা জানালা দিয়ে আলো আসছে। হয়ত কোন ছাত্র বা ছাত্রি রাত জেগে পরীক্ষার পড়া মুখস্ত করছে অথবা কোন দম্পতী একে অন্যের ভালবাসা আদায়ে ব্যাস্ত।

হঠাৎ করে সৌরভ সাহেবের বুকটি হু হু করে উঠে, এক সময় কি দুর্দান্ত প্রেম ছির রুপার সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় ক্লাস ফাকি দিয়ে কতনা জায়গায় দুজনে বসে থেকেছে। ক্যাফেটেরিয়া, শহীদ মিনার, ইবলিশ চত্তর আর একটু শাহস বাড়ার সাথে সাথে সায়েন্স বিল্ডিং এর পেছনে বসে প্রেম করেছে, প্যারিস রোড দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেটেছে কতটা সময়, কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে সেদিকে কারো খেয়াল থাকেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন অনুষ্ঠান বা যে কোন জাতীয় দিবসগুলো তারা এক সাথে আয়োজন করে উপভোগ করত।

হাতে সিগেরেটের আঁচ লাগতেই সৌরভ সাহেব দেখেন সিগেরেটের আগুন ফিল্টার পর্যন্ত চলে এসেছে। সিগেরেটটি দুরে ছুঁড়ে ফেলে বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে আরেকটা সিগেরেট ধরিয়ে আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় গুলিতে ফিরে যান তিনি।

খুব মনে পড়ে সে বার বসন্ত উৎসবের কথা। রুপা আগের দিনই সব পরিকণ্পনা করে সাজিয়ে রাখে কখন কি করবে অথচ সময় মত হল গেটে পৌছিয়ে সেদিন রুপাকে পায়নি সৌরভ। এক ঘন্ঠা বসে থেকে শেষে একটা চিঠি লিখে রুপার এক বান্ধবীর কাছে রেখে আসে। চিঠিটির প্রতিটি বাক্য সৌরভের একনো মনে আছে। নিজের স্মৃতী শক্তিকে আবারো বাজিয়ে নিতে মনে মনে আওড়াতে থাকেন

ভালবাসার নীল রং দেখিনি কখনো। নীল দেখেছি যা জীবনে তার পুরোটা কষ্টের। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে বড় জোর একতলা ছাদ ছোঁবার ইচ্ছাটা দমন করতে পারিনা কিন্তু আকাশ ছোবার স্বপ্নতো প্রশ্নই আসেনা। আর তাই বাশুন্তী রঙা শাড়ী না হোক অন্য যে কোন আটপোরে শাড়ীতে আজ তোমায় দেখব কল্পনা করেছিলাম, বাশুন্তী উৎসবের চেয়ে তোমাকে দেখবার আগ্রহটি মূলত অনুপ্রানিত হয়েছিলাম। তোমাকে না দেখে কষ্ট হয়েছে খুব তবে সে কষ্ট ক্ষমা করলাম কিন্তু এতক্ষন ধরে লেডিজ হলের সামনে বসিয়ে রাখার জন্য তোমার শাস্তি অনিবার্য। ও হ্যাঁ তোমার জন্য ফুল নিয়ে এসেছিলাম, সেই ফুল কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলেছি এবং সেখান থেকে একটা বিশ্রি পোকা বের হয়েছে। শাস্তির কথা মনে রেখ !

সৌরভ সাহেব হাসেন মনে মনে, নিজের স্মৃতী শক্তির প্রশাংসা করেন আপন মনে। হাতের সিগেরেটটি কখন শেষ হয়েছে খেয়ালই করেননি, আরেকটি সিগেরেট জ্বেলে মেলাবার চেষ্টা করেন সেদিনের সেই রুপা ও আজকের এই রুপাকে । যে রুপা এক সময় তার সিগেরেট খাওয়া সহ্য করতে পারত না সেই রুপা এখন তাকে মদ না খাওয়ার জন্য ক্ষ্যাত বলে। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, যেদিন এক পার্টি থেকে ফিরে অনেক রাতে রুপা চিৎকার করে উঠে,

-সবার সাথে একটু ডিংস নিলে কি এমন মহা ভারত অশুদ্ধ হত শুনি?’ রুপার কথায় খুব কষ্ট হলেও নির্বিকারে হজম করতে হয়েছিল তাকে।

পানির তৃষ্ণা পেতেই বাস্তবে ফিরে আসেন তিন। বোতলে মুখ দিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে সামনের বিল্ডিং এর দিকে চায়লেন তিনি, এখন সব লাইট বন্ধ, হয়ত আশ পাশের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু তিনি জেগে আছেন একাকি, তাও আবার তিক্ত অতীত ও কিছুক্ষন আগের এক জ্বালাময় ঘটানাকে স্বরন করে ! মনটা আবারো প্রচন্ড খারাপ হল। রুপার সমস্যাকে এই চোদ্দ বছর ধরে দেখতে দেখতে অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে কিন্তু..................

সৌরব সাহেব শার্টের অস্তিন দিয়ে চোখ মুছলেন। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে আরেকটা সিগেরেট জ্বাললেন। হঠাৎ করে বড় অসহয় মনে হতে লাগল নিজেকে, ঠিক যেমন খাঁচায় বন্দি কোন পাখি । হয়ত এই মুহুর্তে এই বাড়ি ছেড়ে দুরে কোথাও চলে গেলে একটু শান্তি হত।

সৌরভ সাহেব আবারো সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা চিন্তা করেন, তার বারো বছরের একমাত্র মেয়ে এসে তাকে প্রশ্ন করল,

-ড্যাডি আজ মিস বলেছে কাল একুশে। এ জন্য আমাদের প্রভাত ফেরিতে নিয়ে যাবে।

মেয়ের এই কথায় তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন কারন তিনি প্রতি বছরই যান, একা। রুপা বলে,

-শীতের এত সকারে খালি পায়ে হাঁটার কোন মানে হয় !

সৌরভ সাহেব ভাবলেন এবার তিনি মেয়ের সাথেই যাবেন, তিনি অত্যান্ত খুশি হয়ে বললেন,

-বেশতো মা, যাবে

-কিন্তু ড্যাডি আমি যে যাব কিন্তু প্রভাত ফেরিটা জিনিস আর একুশের মানে কি ? বল না ড্যাডি, প্লিজ


সৌরভ সাহেব একে বারে পাথর হয়ে যান মেয়ের কথা শুনে। সৌরভ সাহেবের বাবা একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৭১ এ তিনি অত্যান্ত দাপটের সাথে যুদ্ধ রত অবস্থায় পাক হানাদার বাহীনির হাতে শহীদ হন এ ছাড়া তার দাদা একজন ভাষা সৈনিক। ভাষার জন্য লড়তে গিয়ে উনি দীর্ঘ সময় কারা ভোগ করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনো তারা আপোষ করেননি।সেই দেশ প্রেমিক পরিবারের ওয়ারিশ হয়ে তার মেয়ে জানেনা একুশে কি, প্রভাত ফেরি কি ! সৌরভ সাহেব তার চৌদ্দ বছরের দাম্পত্ত কলহ ভুলে যেতে পারেন কিন্তু এক মাত্র মেয়ের এমন কথা কি ভাবে ভুরবেন !


সেই সন্ধ্যা থেকে তিনি অনেক ভেবেছেন, এ দোষ কার ? তাঁর একার ? কিন্তু তিনিতো পরিস্থিতির স্বীকার মাত্র। মেয়েকে সাথে নিয়ে যে দু'দন্ড কথা বলবেন সে সময় নিজের অফুরন্ত থাকলেও মেয়ের নেয়। স্কুল, কোচিং ছাড়া বাড়িতে যতক্ষন থাকে তার মাঝে তিনি ৪/৫ জন শিক্ষককে আসতে যেতে দেখেন। এছাড়া সঙ্গীত এবং নাচেরতো আলাদা শিক্ষক আছেনই।

সৌবভ সাহেব কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছেন না,

তবে এর জন্য কি রুপা দায়ি ? আবার মনে মনে ভাবেন, মা হিসেবে রুপা যদি দায়ি হয় তবে বাবা হিসেবে তিনিও দায়ি থাকেবেন,


নাকি এশার ইংরেজী স্কুল দায়ি তাকে এ শিক্ষা না দিতে পেরে , নাকি স্কুলের শিক্ষক কিনবা মিসরা ! নাকি বর্তমান পরিবেশ, সমাজ !

সৌরভ সাহেবের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। রাতে কিছই খেতে পারেননি, শোবার আগে চারটি ৫ মিলিগ্রামের ডায়জিপাম থেয়েও ঘুমুতে পারলেন না। মাথা থেকে কিছুতেই দুর করতে পারছেন না ব্যাপারটা। নিজে যাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন সেই পছন্দের মানুষ বিয়ের পরে সম্পুর্ন অন্যরুপ প্রকাশ করল অথচ এই চৌদ্দ বছরে কোন বিষয়ে তিনি রুপার সাথে কোন প্রকার বিরুদ্ধাচারন করেননি। রুপার সব অস্বাভাবিক কাজকে তিনি স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

তবে কোন অবস্থাতেই মেয়ের এই কথাকে তিনি স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না !

মেয়েতো রুপারো, সে যদি না চায় একুশে কি মেয়ে তা না জানুক তবে এটা তাদের মা মেয়ের ব্যাপার, এখানে তার কি কিছু করবার আছে ? অনেক চিন্তা করে কথাটির কোন জবাব বের করতে পারলেন না তিনি। গালাটা আবারো শুকিয়ে গেছে, বোতলটা তুলতেই বুঝলেন খালি। একটা সিগেরেট জ্বালালেন। দুর মসজিদ থেকে আযানের সুর ভেসে আসছে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে তখন করুন আকুতি

-আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম’


সৌরভ সাহেব তার আধা খাওয়া সিগেরেটটি ছুড়ে ফেললেন, মুয়াজ্জিন সাহেবের আযানের মধ্যে তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আর পেছনে নয় এবার সময় সামনে এগুনোর তিনি তার চৌদ্দ বছরের দাম্পত্য কলহ মুখ বুজে হয়েছেন। সয়েছেন মেয়ের ইংরেজী স্কুলে পড়া সহ অনেক অন্যায় আব্দার।


একমাত্র মেয়ের বাংলা ভাষা লিখতে পড়তে না জানার কষ্ট সয়েছেন কিন্তু আর কত ! তার এক মাত্র মেয়েকে আজ বাংগালী সংস্কৃতি ও চেতনা পরিপন্থি চারদিকের হাজারো বিজাতীয় অপ সংস্কৃতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে, যে কোন কিছুর বিনিময়ে !


সৌরব সাহেব আজ সারাদিনে সব কর্মসূচী ঠিক করে রাখলেন, আজ তার আনেক কাজ ! আকাশ আরেকটু ফর্ষা হলেই নেমে যাবেন বাগানে। বড় বড় গোলাপ গুলি তুলে প্রথমে যাবেন শহীদ মিনারে। ওখান থেকে যাবেন দাদুর কবর জিয়ারত করতে। সেখান থেকে বাসায় ফিরেই............।


হ্যাঁ, এই তো সময়।

সৌরভ সাহেবের নিজের প্রতি ঘেন্নায় মন ভরে গেল, আশ্চর্য় কেন আমি এতদিন ধরে........

অবাক বিস্ময়ে তিনি চেয়ে থাকেন পূর্ব দিগন্তের দিকে !


৩.

ভাষা নিয়ে গল্প
মু হা ম্মা দ এ ম দা দু ল্লা হ

ভোর হলো। বেলা গড়িয়ে গেল। অতঃপর আলো হারালো আগামী দিনের জন্য। অনেকদিন হলো, প্রভাতের আলো দেখা যাচ্ছে না। প্রকৃতিতেও কেমন যেন বিষন্নতার আবরণ। আবৃত করে রেখেছে প্রতিটি হৃদয়। পরদিন সকাল হলো। হয়তো আলোর দেখা মিলবে। ধূসরবর্ণ আকাশ। বাতাসের প্রাণে শোকের মাতম। চাপা একটা যন্ত্রণার ব্যথা উপচে পড়ছে সবার হৃদয়ে।

একজন মুসল্লি নামায পড়ে বের হচ্ছেন। মুখভর্তি দাড়ি। গায়ে সফেদ জামা। বেশ-ভ‚ষায় উজ্জ্বল-ঝলমলে। কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে ছড়িয়ে আছে আবছা বেদনা। মসজিদ থেকে বের হয়ে লালবাগ মোড়ের দিকে রওয়ানা হলেন লোকটি।

রাস্তার পাশে একটি কুকুর। খিদের যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পাশেই একটি দোকান। একটুকরো রুটি পড়ে ছিল তার সামনে। তাই নিয়ে লাফালাফি করছে কুকুরটা।

চার-পাঁচটি ছাগল নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন ছেলে। তার মধ্যে একটি বাচ্চা ছাগলও ছিল। একবার ছেলেটির পাশে যায় একবার মায়ের কাছে। চঞ্চল প্রকৃতির। ছেলেটিও বেশ আনন্দের সাথে ছাগলগুলি নিয়ে চলছে। চলতে চলতে একসময় মোড়ে এসে থেমে যায়।

প্রভাতে আলোর মিছিল। মিষ্টি ভোরের স্নিগ্ধ সকাল। ধীরে ধীরে মানুষের আনাগোনা বাড়ে। দেখতে দেখতে শহরের রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। হঠাৎ জনতার উচ্চকিত কণ্ঠে কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস। মুহূর্তেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল লালবাগ মোড়ের চিত্র। কুকুর খাবার ফেলে দিশাহারা হয়ে ছুটল, ভয়ে ছাগলগুলোর দলছুট অবস্থা। এদিকে মুসল্লি হয়ে উঠলেন বিদ্রোহীদের একজন। ভরাট কণ্ঠে আওয়াজ তুললেন, ‘জুলুমবাজী শেষ কর, রাষ্ট্রভাষা বাংলা কর’।

মজিদ ও সুজন খুব ভাল বন্ধু। একই কলেজের ছাত্র। গরীব ঘরের ছেলে মজিদ। বহু কষ্টে লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে। দেশের প্রতি তাদের গভীর ভালবাসা। দু’জনের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত হবে। এ জন্যই তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।

সুজন বাংলাভাষার প্রতি অনুরাগী একজন ছেলে। কবিতা ও সাহিত্যচর্চা করে সবসময়। তার প্রতিভা মজিদকে খুব অনুপ্ররণা জোগায়। কারণ তার বাবাও একই চেতনাবোধের। বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে বাংলা চর্চায় সুজনের খ্যাতি রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সে লেখালেখি করে।

আমি যদি শিক্ষার আলোর প্রসারিত করি তাহলে জাতি তুলনামূলক বেশি শিক্ষিত হবে। হ্যাঁ, যদি দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে কিংবা মায়ের ভাষা নিয়ে কেউ টানাটানি করে, তাহলে ছাড়বো না। দেশের ভালবাসা থেকেই বুকের রক্ত দিয়ে দেশ-জাতি রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।

মজিদ মায়ের একমাত্র ছেলে। ভার্সিটিতে যখন পা রাখছিল তখন বাবা মারা যান। বাবা হারানো যেমন কষ্টের ছিল তেমন মর্মান্তিক বেদনারও। বাবা ছিলেন প্রচন্ড দেশপ্রমিক। তিনি কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন। মজিদের বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন এ দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।

মজিদের বাড়ি রংপুর। ছ’মাস-বছরে গিয়ে দেখা করে আসে। কিছুদিন আগেও দেখা করে এসেছিল। মা আর খালাতো বোন রুনা মিলে তাদের জীর্ণ-শীর্ণ সংসার। রুনার মা-বাবা শিশুকালেই মারা গিয়েছিল। মা-ছেলের উপরেই তার সব আশা-ভরসা আর স্বপ্ন।

ক্যাম্পাসে ফেরার সময় মজিদের মা বলেছিলেনন, ‹সাবধানে চলাফেরা করিস বাবা! ঢাকা শহরের অবস্থা নাকি খুব খারাপ।›

সে মাকে শান্তনা দিয়ে বলে, তোমার ছেলের কিচ্ছু হবে না। যেমন যাচ্ছে, দেখবে এরচে›ও ভালভাবে ফিরে আসবে।

ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। সন্ধা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি পরদিন ২১ তারিখে কী ঘটতে যাচ্ছে! সুজন কলেজের ছাত্রনেতা। তাদের কলেজের ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এবং সলিমুল্লাহ খান হলের ছাত্ররা মিটিং করে জানিয়ে দিয়েছে যে, ভাষাপ্রেমীরা আন্দোলন থেকে পিছপা হতে রাজী নয়। সরকার চোখ রাঙিয়ে, রক্তচক্ষুর ভয় দেখিয়ে কিংবা আরো যা কিছু ইচ্ছা করেও আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ছাত্রনেতাদের এ সিদ্ধান্ত গোটা আন্দোলনের চেহারাই পাল্টে দেয়।

সুজন রুমে আসে। উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে। ছটপট করছে। মাজিদ তার কান্ড দেখে তাকিয়ে থাকে।

কি হয়েছে রে দোস্ত! বাহিরের অবস্থা কী এখন?

সুজন- ওরা নাকি বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে। আমি-আমরা যে ভাষায় মনের কথা বলি ও লিখি, সে ভাষার উপরে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। রাগে তো আমার রক্ত জ্বলে যাচ্ছে!

তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মজিদ। সুজন অনেকটা রাগ-অভিমান মাখিয়ে বলে, তুই পড়ালেখা করে আখের গোছাতে থাক। পরে দেখবি ভাষাও যাবে, শিক্ষাও যাবে। আর শিক্ষিতরা হবে পাকিস্তানিদের কলুর বলদ। আমি এভাবে বসে থাকতে পারবো না। যদি সঙ্গ দিতে ইচ্ছে হয়, তাহলে চল।

মজিদ এই প্রথম সুজনকে ক্ষিপ্ত হতে দেখেছে। সে এভাবে আর বসে থাকতে পারে না। তার মনেও মাতৃভাষা ফিরিয়ে আনার স্পৃহা জাগে। সেও সোনালী একটা আলো দেখতে চায়। সুজনের হাতে হাত রেখে শপথ নেয় মজিদ। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওঠায় ঊর্ধ্বমুখে।

চারদিকে হরতালের স্লোগান। মিছিলের পর মিছিল। উত্তর দিকের গলি দিয়ে ঢুকে পশ্চিমের গলি দিয়ে বেরুচ্ছে। সবার হাতে ছোট বড় প্ল্যাকার্ড। লাল বর্ণে তাতে লেখা- ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’।

বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা স্লোগান- পুলিশের অত্যাচার, মানি না মানব না! ‘পাক পুলিশ নিপাত যাক, বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’।

আমতলায় ছাত্রদের মুষ্টিবদ্ধ অনেকগুলো হাত উঠলো। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার আহ্বানে বক্তৃতা দিচ্ছে সুজন। জড়ো হয়েছে বিভিন্ন কলেজে-ভার্সিটির ছাত্ররা। সুজনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মজিদ। সময় যত যাচ্ছে লোকজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। মিছিলের স্লোগান তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।

‘পাকিস্তানের অত্যাচার মানি না মানবো না’,

‘আমাদের সব দাবি, মানতে হবে মেনে নাও’,

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা, করতে হবে করে দাও’

সরকার থেকে নির্দেশ আসে। মিছিল-মিটিংগুলো লন্ডভন্ড করার জন্য। পুলিশ টিয়ারসেল ছুঁড়ে দেয় মঞ্চের দিকে। বিক্ষিপ্তভাবে ছুটোছুটি করতে শুরু করে ছাত্ররা। কাদানে গ্যাসের আক্রমণ, অসহ্য যন্ত্রণা সবার চোখে মুখে। রাস্তায় তুমুলভাবে জনতার উত্তেজনতা বেড়ে গেছে। ছাত্রদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে লালবাগের কেল্লার ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে মিছিলে গুলি খেয়ে রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে থাকে অনেকে।

সুজন মজিদকে বুকে টেনে নেয়। উত্তপ্ত রাজপথ থেকে আড়াল করতে গিয়ে সহসাই বুকে বুলেট বিদ্ধ হয় মজিদের। পুলিশ মিছিলকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। আরেকটি গুলি এসে বিদ্ধ হল সুজনের বুকে। সবকিছু আচানক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত সুজন মজিদের দিকে তাকায়। দু’হাত বাড়াতে চায়, পারে না। তাকে বাঁচাতে চায়, পারে না। শেষ পর্যন্ত সে নিজেও বাঁচতে পারে না হায়েনার কবল থেকে। যাবার আগে হাতের রক্তাক্ত আঙুলে লিখে যায়, ‘রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই’।

Post a Comment