রংপুরের আঞ্চলিক কবিতা উত্তর বাংলার সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অঞ্চলের কবিতা গ্রামীণ সংস্কৃতি, প্রকৃতি, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ এবং মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি বহন করে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষার ছন্দে লেখা এই কবিতাগুলো সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কথা প্রকাশ করে সহজ-সরল ভাষায়।
রংপুরের কবিতায় স্থান পেয়েছে এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, যেমন তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র নদী এবং বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। কবিতাগুলোতে কৃষকের জীবন, মেলাগুলো, পালাগান, এবং সামাজিক সম্পর্কের বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়। প্রাচীন যুগের "ভাওয়াইয়া" গানও এই আঞ্চলিক কবিতার একটি জনপ্রিয় শাখা, যা রংপুরের জীবনধারার অন্যতম প্রতিচ্ছবি।
প্রেম ও বিরহের উপাখ্যান রংপুরের কবিতায় বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। প্রেমিক-প্রেমিকার মনের আকুতি, দূরত্বের বেদনা এবং প্রতীক্ষার ছবি সুন্দরভাবে কবিতায় ধরা হয়। রংপুরের কবিরা স্থানীয় শব্দ ও উপমা ব্যবহার করে আবেগপূর্ণ এবং হৃদয়গ্রাহী কবিতা রচনা করে থাকেন।
এই কবিতা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং রংপুর অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। এটি উত্তর বাংলার সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ভাষাকে সংরক্ষণে অবদান রাখছে।রংপুরের ভাষায় চারটি কবিতা তুলে ধরা হলো আশা করি পড়লে ভালো লাগবে।
রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা-
"ভাঙ্গা হাড়ি"(আব্দুল্লা আল-মাসুম দিপু)
কি গে মা, কী হইচে মুক ক্যানে তোমার ভারী,
সউগ ক্যানবা আউলা, ভাঙ্গা ক্যানবা হাড়ি।
আব্বা কোটে, তার সাতে ঝগড়া নাগচে নাকি?
তোমার গুলার ঝগড়া থাকে কোন দিনট্যাত বাকি!
তোর বাপের ভাত যদি আর মুই কোনোদিন খাও,
তাইলে দেকিস মুই আনিচার মোকত হইবে ঘাও।
লোকটা মোকে দুই চোকে দেকপ্যার না পায়,
তায় ফির মোর হাতের আন্দন– চাটিপুটি খায়!
এগলা কতা থুয়্যা তোমরা আসল কতা কন,
কী হইচে ঝগড়া ক্যানে, মোর ছটফটাওচে মন।
শুন তাইলে,
বকরিগুল্যা নিয়ে মুই– গেছনু দোলাবাড়ি,
তোর বাপ এমন সময়ে আচচে বেলে বাড়ি।
মনের ভুলে,
দুদের বোতলত; মুই দেওনাই দেকি কাগ,
দোলাবাড়িত যায়্যা মোক দেখাইচে আগ।
স্যাটে কোনো আছিল জানিস আনা কানার বউ,
আরও আছিল অটে কোনা তোর ছোট চাচি মউ।
সবার সামনোত তোর বাপ কতল্যা কতা কইচে,
এই নিয়ে হামার মাঝোত মেলা ঝগড়া হইচে।
বাড়ি আসি যকনে কনু, এগল্যা ক্যানে কইনেন,
দুদগুল্যা কি নষ্ট হইচে, অটে ক্যানে মইনেন।
হাড়ি পাতিল যা আছে সব আচড়ে ফেলাইল ভাঙ্গি,
যাইতে যাইতে আবার মোর ভাঙচে শকের জাঙ্গি।
গামলাত মুই তোর জন্যে ভাত থুচু তুলি,
সময় করি খায়্যা নেইস যাইসনা যেন ভুলি।
তোর বাপ আসলে কইস, কিনব্যার নয়া হাড়ি,
ততদিনের জন্যে মুই– যাউছু বাপের বাড়ি।
রংপুরের ভাষায় কবিতা
ঝড়ি
--------------------------------
ওরে ঝড়ি এবার থাম,
পরি আছে ম্যালা কাম।
বাইরত গেঈলে ভেজে গাও,
ক্যাঙ্করি মুই বাইরত যাও?
থামেক থামেক ঝড়িরে,
কং যে বিনয় করিরে!
দোলাত হইছে ম্যালা জল,
সউগে হয়া গেইছে তল।
ব্যাঙ কান্দে ডোরত ডোরত;
ছাগল ভেড়া কান্দে ঘরত।
গরু গিল্যাও হামলে মরে,
তিনদিন থাকি বন্ধ ঘরে!
বাইরত যাবার উপায় নাই,
খেড়-খাবার দেয় কাঁয়?
ভিজিয়া যদি যাবার চাং,
বিজলী দেখি ভয় পাং।
চলাৎ করি ঠাডা পরে,
দৌড়ি সোন্দাং আন্দন ঘরে।
আন্দন ঘরের ভাঙ্গা চাল,
টোপায় টোপায় পরে জল!
ভিজালু মোর পেন্দনের শাড়ী,
মোর সাথে তোর কিসের আড়ি?
কোলার ছাওয়া বিচনাত শুতি,
নিন্দতে থুইছে খেতাঁত মুতি!
নাই অইদ নাই বাঁও,
কোন্ঠে এগিলা শুকির দেওঁ??
লেখক: Ashraful Alam
“মোক বোদায় ভুলি গেছিস”
মেহেনাজ পারভীন
কায়বা সেদিন কইল, তোক ফেসবুকত দেখচে, তুই বোলে আদাবুড়ে হছিস!
এলা কি তোর কোনো হিল্লে হইছে?
কেংকা আছিস, কি করিস, মুই কিছুই জানো না!
মোক একখান চিটি দিছলু- মোর সাতে আওচাও কাড়লে তোক ভালো নাগে,
দেওয়ার ঝড়িত ভিজবের মোনায়,
আইলের ধারত বসি গপ্প করবের চাইস, কচুয়ের বিলের পদ্মফুল তুলি দিছলু।
তুই মোক কছলু-‘ফুলতি’ তোক মুই ভালোবাসো।
পেল্কা, সোল্কা আর সেদোল ভালো করি আন্দা শিখিস।
মনে করি দেকতো- একদিন শুননু-
এইলে কতা শুনবের পায়া তোর বাপ কাড়াইল দি ডাংগে তোর হাতের কল্কুনে ফাটে দেছে।
তোর মাও বেল্লা দি ঢেলাইছে। তারপর হামার বাড়ির সিমনেত তোক দ্যাখো নাই।
ছইঞ্চালিতও আর আসিস নেই।ঝরকার শিক ধরি নটকি থাকাও দেখো নাই।
মোর আগপাকে আর একদিনও কেম্বা আসিস নেই?
তোক দেখপের না পায়া মোর জিউ আউলি গেছিল।
কাউয়ে চিলের ন্যাকান ছটপটে বেড়াছু।
এলাও মাজে মদ্দে তোর কতা মনে পড়ে।
সোজায় হাটো - রাজবংশী/রংপুরি কবিতা
ঘাটাখান কিন্তু সোজায় গেইচে
ঘাটার বগলের গ্রামগুলা নিন্দে আধমরা
দেওআত মেঘ, কুটকুটা আন্ধার আইত(রাত)
মিটমিট করি চ্যায়া দ্যাকে নিবুঝতারা।
ধুমা(ধোঁয়া) দিয়া আটকি যায় নিকাশ(নিঃশ্বাস)
তারপরেও বোল আছিলাম বেশ
নয়া যুগোত আসিল বোলে নয়া স্বাধীনতা
সগারে দাবি-দবাতে আউলি যায়চে দেশ।
দেশের এ্যলাবোল বেশ টলোমো অবস্থা
তোমরাগুলা কি বাচার মত বাচপার চান
তা ঘাটাখান সোজায় গেইচে জানিয়াও
ক্যানেবা তোমরা বাকা ঘাটাত যান।।
____মিজানুর রহমান রাজবংশী
২২/১০/২০২৪ খ্রি: