মেজর ডালিমসহ কিছু সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই ঘটনার পেছনে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামরিক বিভিন্ন কারণ কাজ করেছিল।
মূল কারণসমূহ:
সামরিক অসন্তোষ:
সামরিক বাহিনীর কিছু অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন ও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ মনে করত যে, তাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং বেসামরিক প্রশাসনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ব্যক্তিগত প্রতিশোধ:
মেজর ডালিমের স্ত্রীকে একবার বঙ্গবন্ধুর অনুগতদের দ্বারা অপমানিত করা হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। এ ঘটনাটি ডালিমের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষোভ তৈরি করে, যা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার একটি ব্যক্তিগত কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা:
১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ও সমালোচনা তৈরি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা সামরিক এবং রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল।
সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা:
সামরিক বাহিনীর একটি অংশ মনে করত, দেশের নেতৃত্ব পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল।
বহির্বিশ্বের প্রভাব:
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।
মেজর ডালিম কে
মেজর শরিফুল হক ডালিম ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা, যিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কুশীলব হিসেবে পরিচিত।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
- পূর্ণ নাম: শরিফুল হক ডালিম
- পদবি: মেজর (১৯৭৫ সালে)
- পেশা: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা:
মেজর ডালিম ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেন এবং এই ঘটনায় অন্যতম সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তিনি সামরিক সরকারে সুবিধাভোগী ছিলেন।
অভ্যুত্থানের পর:
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ডালিম ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার পালাবদল হলে ডালিমসহ অন্যান্য অভ্যুত্থানকারীরা বিদেশে চলে যান।
বিদেশে জীবন:
শরিফুল হক ডালিম দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশে (যেমন পাকিস্তান, লিবিয়া, জিম্বাবুয়ে) কূটনৈতিক দায়িত্বে ছিলেন।
বিচার ও দণ্ড:
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মেজর ডালিমসহ অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তবে ডালিম পালিয়ে থাকায় তার দণ্ড এখনো কার্যকর হয়নি। তিনি এখনো পলাতক আছেন বলে জানা যায়।
মেজর ডালিম এর জীবনী
মেজর শরিফুল হক ডালিম (জন্ম: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬) ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা, যিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন ও সামরিক ক্যারিয়ার
ডালিম ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তিনি বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে স্থানান্তরিত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৭১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ডালিম পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। ২০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার অসাধারণ সাহস ও কৃতিত্বের জন্য তিনি 'বীর উত্তম' খেতাবে ভূষিত হন। তবে ২০২১ সালের ৬ জুন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ডালিমসহ কিছু সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অংশ নেন। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বাংলাদেশ বেতারে ঘোষণা দেন:
"আমি মেজর ডালিম বলছি, খন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। শেখ মুজিব ও তার খুনী-দুর্নীতিবাজ সরকারকে উৎখাত করা হইয়াছে। এখন থেকে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করা হলো। আপনারা সবাই আমাদের সহযোগিতা করুন। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনো অসুবিধা আপনাদের হইবে না। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!"
পরবর্তী জীবন
হত্যাকাণ্ডের পর ডালিমকে সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয় এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত হয়ে চীন, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং কেনিয়ায় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বিচার ও দণ্ড
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। মেজর ডালিমসহ অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তবে ডালিম পলাতক থাকায় তার দণ্ড কার্যকর হয়নি।
সাম্প্রতিক উপস্থিতি
২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি, মেজর ডালিম প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলের একটি লাইভ সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে তিনি তার জীবন, সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন।