লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম (১৯৩৬-১৯৮১): স্বাধীনতার ঘোষক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ছিলেন একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, সেনাপ্রধান এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তার বীরত্ব, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক কৌশল তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
প্রথম জীবন
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার বাগবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মনসুর রহমান কলকাতায় সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিলেন। শৈশব কাটে আংশিক বগুড়া ও কলকাতায়। ভারত বিভাজনের পর তার পরিবার করাচিতে স্থানান্তরিত হলে, তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুল ছেড়ে করাচির একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি করাচির ডিজে কলেজে ভর্তি হন এবং একই বছর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
সামরিক জীবন
১৯৫৫ সালে জিয়াউর রহমান সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং ১৯৫৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে তার নেতৃত্বাধীন কোম্পানি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হন।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর মেজর জিয়া বিদ্রোহ করেন। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক, এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।”
জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে এবং জেড ফোর্সের (Z Force) ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান, ‘বীর উত্তম’ পদকে ভূষিত করা হয়।
রাজনৈতিক উত্থান ও রাষ্ট্রপতি পদ
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং ১৯৭৭ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ যুক্ত করেন এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রবর্তন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন।
অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন
জিয়ার অর্থনৈতিক নীতি বেসরকারি খাতের বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করে। তিনি কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি প্রদান, খাল খনন কর্মসূচি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। তার শাসনামলে খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড বৃদ্ধি ঘটে এবং দেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য উন্নতি লাভ করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সার্ক গঠন
জিয়াউর রহমান দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা দেন। তার প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয়।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। তাকে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে সমাহিত করা হয়।
উপসংহার
জিয়াউর রহমান ছিলেন এক অসামান্য নেতা, যিনি তার শাসনামলে দেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। তার প্রবর্তিত ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ আজও বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।