বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন যা ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলনের সময় গঠিত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, যার ফলস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
সংগঠনটি ২০২৪ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ৮ জুলাই একটি ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। আন্দোলনটির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ৩ আগস্ট, সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি ১৫৮ সদস্যবিশিষ্ট সমন্বয়ক দল গঠন করে, যার মধ্যে ৪৯ জন সমন্বয়ক ও ১০৯ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নেতা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী রিফাত রশিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সারজিস আলম, ইংরেজি বিভাগের হাসনাত আবদুল্লাহ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের আসিফ মাহমুদ, ভূগোল বিভাগের আবু বাকের মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের খান তালাত মাহমুদ রাফি, এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল।
- ২০২৪ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' গঠন করে এবং চার দফা দাবিতে লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে। ২ থেকে ৬ জুলাই বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, এবং মহাসড়ক অবরোধ অনুষ্ঠিত হয়। ৭ জুলাই ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ করে এবং রাস্তা অবরোধের মাধ্যমে 'বাংলা ব্লকেড' নামে দেশব্যাপী কর্মসূচি চালু হয়। রাজধানীতে এই সময় শুধু মেট্রো রেল চলাচল করছিল।
আন্দোলনের ক্রমবিকাশ
১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের "রাজাকারের নাতি-পুতি" বলে আখ্যায়িত করেন, যার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান তোলে: “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।”
১৯ জুলাই সর্বাত্মক অবরোধ চলাকালীন নাহিদ ইসলামসহ আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। একই রাতে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির সঙ্গে আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আট দফা দাবি উত্থাপিত হয়। তবে আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় এবং ২১ জুলাই আন্দোলনের একটি পক্ষ নয় দফা দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
আন্দোলনের বিস্তৃতি ও সংঘর্ষ
২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ তিনজন সমন্বয়ককে হাসপাতালে সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যায়। এরপর ২৭ জুলাই আরও দুইজন সমন্বয়ককে গোয়েন্দা শাখা হেফাজতে নেয়। ২৮ জুলাই আন্দোলনকারীরা আটক নেতাদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে আল্টিমেটাম দেয়। এই সময় শিক্ষার্থীরা দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি এবং মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে।
চূড়ান্ত পর্যায়
৩ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়, যার মধ্যে ট্যাক্স প্রদান বন্ধ, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল পরিশোধ স্থগিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, এবং অফিস আদালত বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনকারীরা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি উত্থাপন করে।
৫ আগস্ট 'লং মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি পালন করা হয়। এইদিন সংঘর্ষে ১০৮ জন নিহত হন। ঐ দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
আন্দোলন-পরবর্তী সময়
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। ৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের পর মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৮ আগস্ট নতুন সরকার শপথ নেয়।
২২ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চার সদস্যের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে হাসনাত আবদুল্লাহ আহ্বায়ক, আরিফ সোহেল সদস্য সচিব, আবদুল হান্নান মাসউদ মুখ্য সংগঠক এবং উমামা ফাতেমা মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আন্দোলনের প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সামাজিক বৈষম্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।