শীতকাল নিয়ে কবিতা।শীতের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা। শীত নিয়ে সেরা কবিতা।শীত নিয়ে বিখ্যাত কবিতা

শীতকাল বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ঋতু। এসময় আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকে, আর প্রকৃতিতে একধরনের নীরবতা নেমে আসে। শীতকালে সকালবেলা কুয়াশা ছড়িয়ে থাকে, আর গাছের পাতায় শিশিরবিন্দু জমে। এই সময় গরম কাপড় পরতে হয়, আর মানুষ খেজুরের রস, পিঠা-পুলি খেয়ে শীত উপভোগ করে। গ্রামে খেজুরের গুড় আর নানা রকম পিঠার আয়োজন দেখা যায়। শহরে মানুষ শীতের ছুটিতে ভ্রমণে বের হয়। শীতকাল অনেক ফসলের মৌসুম, বিশেষ করে সরিষা, গম, এবং শাকসবজি প্রচুর হয়। শীতের সকাল আর বিকেল একসাথে গল্প করা ও পরিবার নিয়ে আনন্দ করার উপযুক্ত সময়।প্রিয় পাঠক আজকে আমরা শীত নিয়ে সেরা কবিতাগুলো পড়বো।

পৌষ 
কাজী নজরুল ইসলাম

পউষ এলো গো!
    পউষ এলো অশ্র”-পাথার হিম পারাবার পারায়ে
ঐ যে এলো গো-
    কুজঝটিকার ঘোম্‌টা-পরা দিগন-রে দাঁড়ায়ে।।
সে এলো আর পাতায় পাতায় হায়
বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়,
অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়
    পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে।।
 
পউষ এলো গো-
    এক বছরের শ্রানি- পথের, কালের আয়ু-ক্ষয়,
    পাকা ধানের বিদায়-ঋতু, নতুন আসার ভয়।
পউষ এলো গো! পউষ এলো-
শুক্‌নো নিশাস্‌, কাঁদন-ভারাতুর
বিদায়-ক্ষণের (আ-হা) ভাঙা গলার সুর-
‘ ওঠে পথিক! যাবে অনেক দূর
কালো চোখের কর”ণ চাওয়া ছাড়ায়ে।।’

শীত এলে মনে হয় 
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


মাঠ থেকে উঠে ওরা এখন গোলায় শুয়ে আছে
সোনালী ফসল, কত রোদ ও বৃষ্টির স্বপ্ন যেন
স্নেহ লেগে আছে
লাউমাচায়, গরু ও গরুর ভর্তা সবান্ধব পুকুরের পাশে
মুখে বিশ্রামের ছবি, যদিও কোমরে গ্যাঁটে ব্যাথা ।

শীত এলে মনে হয়, এবার দুপুর থেকে রাত
মধুময় হয়ে যাবে, যে রকম চেয়েছেন পিতৃপিতামহ
তাদের মৃত্যুর আগে ভেবেছেন আর দুটো বছর যদি…
শীত এলে মনে হয়, এই মাত্র পার হল সেই দু’বছর
এবার সমস্ত কিছু……
শীত চলে যায়, বছর বছর শীত চলে যায়,
সে দুটি বছর আর কখনো আসেনা ।

এই সব ভালো লাগে 
– জীবনানন্দ দাশ


(এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –
এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,
পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে
ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,
নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –
পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে

কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;
তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে
মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;
তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;
পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;
কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।
নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো
কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’


শীতের বিদায় 
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তুঙ্গ তোমার ধবলশৃঙ্গশিরে

উদাসীন শীত, যেতে চাও বুঝি ফিরে?

চিন্তা কি নাই সঁপিতে রাজ্যভার

নবীনের হাতে, চপল চিত্ত যার।

হেলায় যে-জন ফেলায় সকল তার

অমিত দানের বেগে?

দণ্ড তোমার তার হাতে বেণু হবে,

প্রতাপের দাপ মিলাবে গানের রবে,

শাসন ভুলিয়া মিলনের উৎসবে

জাগাবে, রহিবে জেগে।

সে যে মুছে দিবে তোমার আঘাতচিহ্ন,

কঠোর বাঁধন করিবে ছিন্ন ছিন্ন।

এতদিন তুমি বনের মজ্জামাঝে

বন্দী রেখেছ যৌবনে কোন্‌ কাজে,

ছাড়া পেয়ে আজ কত অপরূপ সাজে

বাহিরিবে ফুলে দলে।

তব আসনের সম্মুখে যার বাণী

আবদ্ধ ছিল বহুকাল ভয় মানি’

কণ্ঠ তাহার বাতাসেরে দিবে হানি’

বিচিত্র কোলাহলে।

তোমার নিয়মে বিবর্ণ ছিল সজ্জা,

নগ্ন তরুর শাখা পেত তাই লজ্জা।

তাহার আদেশে আজি নিখিলের বেশে

নীল পীত রাঙা নানা রঙ ফিরে এসে,

আকাশের আঁখি ডুবাইবে রসাবেশে

জাগাইবে মত্ততা।

সম্পদ তুমি যার যত নিলে হরি’

তার বহুগুণ ও যে দিতে চায় ভরি,

পল্লবে যার ক্ষতি ঘটেছিল ঝরি,

ফুল পাবে সেই লতা।

ক্ষয়ের দুঃখে দীক্ষা যাহারে দিলে,

সব দিকে যার বাহুল্য ঘুচাইলে,

প্রাচুর্যে তারি হল আজি অধিকার।

দক্ষিণবায়ু এই বলে বার বার,

বাঁধন-সিদ্ধ যে-জন তাহারি দ্বার

খুলিবে সকলখানে।

কঠিন করিয়া রচিলে পত্রখানি

রসভারে তাই হবে না তাহার হানি,

লুঠি লও ধন, মনে মনে এই জানি,

দৈন্য পুরিবে দানে।


ওগো শীত 
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


ওগো শীত, ওগো শুভ্র, হে তীব্র নির্মম,

তোমার উত্তরবায়ু দুরন্ত দুর্দম

অরণ্যের বক্ষ হানে। বনস্পতি যত

থর থর কম্পমান, শীর্ষ করি নত

আদেশ-নির্ঘোষ তব মানে। “জীর্ণতার

মোহবন্ধ ছিন্ন করো’ এ বাক্য তোমার

ফিরিছে প্রচার করি জয়ডঙ্কা তব

দিকে দিকে। কুঞ্জে কুঞ্জে মৃত্যুর বিপ্লব

করিছে বিকীর্ণ শীর্ণ পর্ণ রাশি রাশি

শূন্য নগ্ন করি শাখা, নিঃশেষে বিনাশি

অকাল-পুষ্পের দুঃসাহস।

হে নির্মল,

সংশয়-উদ্বিগ্ন চিত্তে পূর্ণ করো বল।

মৃত্যু-অঞ্জলিতে ভরো অমৃতের ধারা,

ভীষণের স্পর্শঘাতে করো শঙ্কাহারা,

শূন্য করি দাও মন; সর্বস্বান্ত ক্ষতি

অন্তরে ধরুক শান্ত উদাত্ত মুরতি,

হে বৈরাগী। অতীতের আবর্জনাভার,

সঞ্চিত লাঞ্ছনা গ্লানি শ্রান্তি ভ্রান্তি তার

সম্মার্জন করি দাও। বসন্তের কবি

শূন্যতার শুভ্র পত্রে পূর্ণতার ছবি

লেখে আসি’, সে-শূন্য তোমারি আয়োজন,

সেইমতো মোর চিত্তে পূর্ণের আসন

মুক্ত করো রুদ্র-হস্তে; কুজ্‌ঝটিকারাশি

রাখুক পুঞ্জিত করি প্রসন্নের হাসি।

বাজুক তোমার শঙ্খ মোর বক্ষতলে

নিঃশঙ্ক দুর্জয়। কঠোর উদগ্রবলে

দুর্বলেরে করো তিরস্কার; অট্টহাসে

নিষ্ঠুর ভাগ্যেরে পরিহাসো; হিমশ্বাসে

আরাম করুক ধূলিসাৎ। হে নির্মম,

গর্বহরা, সর্বনাশা, নমো নমো নমঃ।



শীতে ভালোবাসা পদ্ধতি 
– আবুল হাসান


কনক তুমি শীতে এবার কার্ডিগানটা পরো কেমন?
আমাকে তুমি শিখিয়ে দিও লালঝুটো সেই পাখির নামটি?
কনক আমরা এবার শীতে নদীর তীরে হো হো হাসবো
সন্ধেবেলা তোমার চুলে শিশির ভরে রাখবো লক্ষ্মী
তোমার অনামিকায় কামড় দিয়ে আমি হঠাৎ আবার
‘যাহ-কী-দুষ্ট’ ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠ ছোঁবো সকাল বেলায়
সূর্যোদয়ের কাছে কেবল শান্তি চাইবো, বুঝলে কনক
তোমার মাথাধরাও আমি এক চুমোতে সারিয়ে দেবো!



আমার কুঁড়েঘরে 
– হুমায়ুন আজাদ


আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক
 
আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক
 
আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক
 
আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক
 
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক


শীতের রোদ্দুর 
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শীতের রোদ্দুর।
সোনা-মেশা সবুজের ঢেউ
স্তম্ভিত হয়ে আছে সেগুন বনে।
বেগনি-ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা
ঝুরি-নামা বৃদ্ধ বট
ডাল মেলেছে রাস্তার ওপার পর্যন্ত।
ফলসাগাছের ঝরা পাতা
হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে
ধুলোর সাঙাত হয়ে।
কাজ-ভোলা এই দিন
উধাও বলাকার মতো
লীন হয়ে চলেছে নিঃসীম নীলিমায়।
ঝাউগাছের মর্মরধ্বনিতে মিশে
মনের মধ্যে এই কথাটি উঠছে বেজে,
“আমি আছি।”
কুয়োতলার কাছে
সামান্য ঐ আমের গাছ;
সারা বছর ও থাকে আত্মবিস্মৃত,
বনের সাধারণ সবুজের আবরণে
ও থাকে ঢাকা।
এমন সময় মাঘের শেষে
হঠাৎ মাটির নিচে
শিকড়ে শিকড়ে তার শিহর লাগে,
শাখায় শাখায় মুকুলিত হয়ে ওঠে বাণী–
“আমি আছি,”
চন্দ্রসূর্যের আলো আপন ভাষায়
স্বীকার করে তার সেই ভাষা।
অলস মনের শিয়রে দাঁড়িয়ে
হাসেন অন্তর্যামী,
হঠাৎ দেন ঠেকিয়ে সোনার কাঠি
প্রিয়ার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি দিয়ে,
কবির গানের সুর দিয়ে,
তখন যে-আমি ধূলিধূসর সামান্য দিনগুলির
মধ্যে মিলিয়ে ছিল,
সে দেখা দেয় এক নিমেষের অসমান্য আলোকে।
সে-সব দুর্মূল্য নিমেষ
কোনো রত্নভাণ্ডারে থেকে যায় কি না জানিনে;
এইটুকু জানি–
তারা এসেছে আমার আত্মবিস্মৃতির মধ্যে,
জাগিয়েছে আমার মর্মে
বিশ্বমর্মের নিত্যকালের সেই বাণী
“আমি আছি।”

শীত রাত
জীবনানন্দ দাশ

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;

বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,

কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।


শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে –

সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।


এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে;

কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?

কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?

তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,

তারা কিশোর নয়,

কিশোরী নয় আর;

কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।


সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে:

সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,

স্থবির সিংহ এক – আফিমের সিংহ – অন্ধ – অন্ধকার।

চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে

মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।


সিংহ অরন্যকে পাবে না আর

পাবে না আর

পাবে না আর

কোকিলের গান

বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে

চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।

হে পৃথিবী,

হে বিপাশামদির নাগপাশ, – তুমি

পাশ ফিরে শোও,

কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।


গ্রামীণ শীতের ভোর
বোরহানুল ইসলাম লিটন 


শীতের খেজুর রস,

দেখলে কে না হয় খুশিতে

চঞ্চলা সরস?


থাকলে সাথে মুড়ি,

আর কি খাটে কথার মাঝে

হিমের জারি-জুরি!


খুব সকালে দেয় যদি মা

গরম ভাপার থালা,

আর কে থাকে কালা?

লালি যদি দেয় খুলে তার

গন্ধে মনের তালা?


রসে ডোবা চিতই পিঠা

খায় যদি বা খুকি,

সূর্য কি রয় লুকি!

’আয় রোদে আয়’ ছোট্ট সোনা

দেয় সে ডেকেই উঁকি!


গ্রামীণ শীতের ভোর,

এমনি ভাবেই রোজ খুলে তার

শিশির ঝরা দোর!


শীতের সকাল
সুনির্মল বসু

আবছায়া চারিদিক, ঝাপসা নিঝুম,

পউষের ভোরবেলা—ভেঙে গেল ঘুম।

উষার দুয়ারে এক তুষারের ঢেউ

কখন পড়েছে ভেঙে, জানে না তা কেউ।

ঝিমঝিমে হিম-হাওয়া বয় বার বার,

দিকে দিকে বাজে যেন শীতের সেতার।

অশথগাছের ফাঁকে অতি মনোহর

মিঠে রোদ বেঁকে পড়ে দাওয়ার উপর;

জড়সড় দেহ মোর,—বড় শীত ভাই,

রোদ-ছাওয়া দাওয়াটায় বসি এসে তাই;

দুরে দেখি ফাঁকা মাঠে আলো ঝলমল,

শালিখের ঝাঁক সেথা করে কোলাহল।


ছোট টুনটুনি পাখী কাতর বেজায়,

ভিজে ঘাসে কি যে খোঁজে, শরীর ভেজায়।

কে ডাকে করুণ সুরে—শুনিস না তুই?

খাবার খুঁজিয়া ফেরে চপল চড়ুই।

বখরা লইয়া যত ঝগড়াটে কাক।

ঘরের খড়ের চালে করে হাঁকডাক।

আমাদের ছোট দীঘি ঐ দেখা যায়,

 চিক‍্চিক্ করে জল রোদের আভায়;

ফোটো-ফোটো ছোেট-ছোট শালুকের ফুল,

পাতায় শিশিরকণা করে টুলটুল।

শীত শীত, বড় শীত,—শরীর কাঁপায়,

দাওয়ায় পড়েছে রোদ, বসেছি সেথায়।

নদীটির একপাশে মোদের কুটির,

তার ধারে ছোট ক্ষেত মটরশুঁটির;

ভিজে-ডানা প্রজাপতি আসে আর যায়,

থর্ থর্ কাঁপে যেন হিমেল হাওয়ায়।

হিমে-ভেজা দুনিয়াটা করে ছল্ ছল্;

কখন নেমেছে জানি হিমের বাদল!

ভিজে মাঠ, ভিজে ঘাট, শিশির শীতল,

ভিজে ভিজে পথখানি হয়েছে পিছল।

করবীগাছের ডালে রোদ স’রে যায়

শালিকের ছোট ছানা পালখ শুকায়।

এখনো সুদূরে দেখি মেলিয়া নয়ন—

ধোঁয়া আর কুয়াশার গাঢ় আবরণ।

পউষের মিঠে রোদে বসেছি দাওয়ায়,

নলেন গুড়ের পিঠে খাবি কে রে আয়॥

শীতের প্রকৃতি
- উত্তম চক্রবর্তী


সকালে শীতের রবি উঠে উষ্ণ হেসে,

কুয়াশা চাদর ভেঙে গায়ে লাগে এসে।

গরম চায়ের কাপে চুমুকে যে রেশ,

মুড়িমোয়া নাড়ূও যে খেতে মজা বেশ।


বিকেলে সূর্যটা ডুবে গোধূলি আসন্ন,

পৌষের কুয়াশা আজ ধোঁয়াতে আচ্ছন্ন।

শীতকালে পরিধেয় শীতে তীব্রতর,

যেমন আঘাত হানে মহামারী ঝড়।


তীব্র থেকে তীব্রতর হয় প্রতিদিন,

মহাকষ্টে গরীবেরা আছে নিদ্রাহীন।

শীতঋতু বেশ মজা জানে লোকে তবে,

খাওয়া দাওয়া শান্তি পরিধানে সবে।


হাঁড়িতে আগুন নিয়ে পোহানো আরাম,

বিছানায় লেপ মুড়ি ঘুমানো গরম।

ঘরে ঘরে পিঠেপুলি খেয়ে মজা তবে,

খেঁজুরের রসে ভিজে ভাপা পিঠে খাবে।


ঠান্ডার প্রকোপ থকে মুক্ত হতে হবে,

গরম কাপড়ে লোক মোড়ানোতে তবে।

পৌষও মাঘেতে শীত চলিবে এভাবে,

ধরনীর নিয়মেতে প্রকৃতি খেলিবে।


শীত পার্বণ
 – সুপ্রতীম সিংহ রায়


ঝিলমিল শেষে সব একাকার

হিমেল হাওয়ায় বরফ জোগায়,

শীতঘুম আর কুয়াশা পরশ

উৎসব দিন নিভৃতে ঘুমায়।


পৌষের ভোর হিম হিম ভাব

লেপ মোড়া রাত দমকা আদর,

মাফলারে মুখ ঢাকা পড়ে যায়

বাড়তি গায়ে পশম চাদর।


কফিমগ ধোঁয়া তোমার সকাল

আমার বুকে মাদল বাজে,

পিকনিক ভোরে প্রথম দেখা

সরস্বতী মুখ, চোখের খাঁজে।


সূর্য তাপের দম্ভ ছোট

রাত্রি পাওনা বাড়তি ক্ষণ,

হলুদ শাড়ি, অঞ্জলী দেওয়া

বুক ধুকপুক কিশোরী মন।


এবার তবে হাত-গা সেঁকি

পাপপোড়া সব নিভু আগুনে,

উষ্ণতা ওম বুক ভরে নিই

রং মাখব ফের ফাগুনে।


আর কটা দিন এমনই কাটুক

হিমেল হাওয়ার বরফ চেখে,

বেশ চলে যাও, যদি ডাকে দোল

শেষ চুমু দেব আদর মেখে।


শীত 
– সৃজা ঘোষ

শীতের ভেতর লেপ-কাঁথা নেই। জড়িয়ে ধরো, জড়িয়ে ধরো…

গোপনে পাশ ফেরার আগে, বাঁ দিক বেয়ে আদর করো।

আদর করো কপাল জুড়ে, শরীর আমার ভাল্লাগে না।

হাত-পা খেলা অনেক হলো, এখন ওতে ‘রাত’ জাগে না।

শীতের শরীর ছাপোষা খুব, প্রেম সাজিয়ো নিম্নগামী-

শরীর দুটো মিশ খেতে চায়, আমার সংগে একলা আমি।

আদর করো, আদর করো, স্বল্প শীত-ই উষ্ণতাখোর।

লেপের নীচে বালিশ খেলায়, নীল হয়ে যায় একটা প্রহর…

শীত কাটেনা, গরম শহর, চায়ের আগে চুম্বন চাই ;

যাবজ্জীবন চাতক-গায়ে মিথ্যে, গোপন বাক্স সাজাই।

এখন চাদর ব্যাতিক্রমী, উলট-পুরাণ হতেও পারে-

মন, মানসিক অনেক হল, আদর মাখাও অন্য পারে…

আগুন আনো, আগুন আনো, শরীর জ্বালাও সবার আগে

শীতের ভেতর ঋণ থেকে যাক বিচ্ছিরি সব পোড়ার দাগে।

এখন লেপ-ই আকাশ আমার- সাজাও তারা, জোছনা বোনো-

ঘর বাড়ি নেই। যাবজ্জীবন বসত দিবি অন্য কোনো?

ঘর দোর নেই, বুকটা ছাড়া। শার্টের গন্ধ হারিয়ে গেলে,

আমিও উধাও অন্য গ্রহে, ইতস্ততঃ ঝিনুক পেলে।

শীতের ধোঁয়ায় ভুল করেছি, ভুল করছি মৃত্যু চিনে।

তুমিও আমায় ঠিক বোঝোনি, ঠিক বাঁধোনি শক্ত ঋণে…

ফাঁক রেখোনা, ফাঁক রেখোনা, চুম্বনে বিষ ঢালো।

নীল ছুঁই আর শরীর চেনাই- মিশলে ওটাও কালো(ই)।

নষ্ট হয়ে যাচ্ছি প্রভু, শীত সরিয়ে নাও…

বুকের ভেতর, মুখের ভেতর ব্যথার স্মৃতি দাও।

লেপের ভেতর বইছে নদী, পাশ ফিরেছি যেই-

নগ্নতাতে উথাল-পাথাল ‘দ্বিতীয় সুখ’ আর নেই।

পায়ের পাতায় আলাপচারী ওষ্ঠ এখন চাই…

দারুণ শীতে ভেতর ভেতর ‘নষ্ট’ বনে যাই।।


শীতের আগমন
- বিজন অধিকারী

হিম হিম বইছে মৃদ হাওয়া শীতের কি কাপন,

বছর ঘুরে আবার এলো শীতের এই আগমণ।


শষ্য ফুলের মিলন মেয়লায় প্রকৃতি অপরূপ সাজে,

কুয়াশার ঐ চাদরে ঘেরা শিশির ভেজা ঘাসে।


গাছি কাটে খেজুর গাছ লয়ে আনন্দে উচ্ছাস,

শিশু, কিশোর খেজুর রসে মেতে ওঠে উল্লাস।


পৌষ, মাঘে বাড়িতে বাড়িতে হরেক মজার পিঠা,

শীতের বেলায় পিঠা পুলি লাগে বড্ড মিঠা।


পথ শিশু, গরিব দুখি শীতের ভরা যৌবন,

শীত বস্ত্রের অভাবে তারা করে মানবেতর জীবন।


গরীব দুখি অনাথ শিশুর গরম কাপড়ের সঙ্কট,

রাখবো না তাদের শীত কষ্টে বাঁধবো সবাই জোট।

Post a Comment