শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ (জন্ম: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা, দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। দুই দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর, ২০২৪ সালে ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের ফলে তার শাসনের অবসান ঘটে। তিনি ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৯১ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটলে শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশ নেন, কিন্তু খালেদা জিয়ার কাছে পরাজিত হন। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তিনি তৎকালীন সরকারকে নির্বাচন ও রাজনৈতিক অসততার জন্য দায়ী করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার মেয়াদে দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। ২০০১ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচনে পরাজিত হন।
২০০৮ সালে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকট শেষে শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-২০২৪) উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, এবং গণতান্ত্রিক সংকোচনের অভিযোগ উঠে। তার সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগে সমালোচিত হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটে, যা তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শৈশবে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বেড়ে ওঠেন। ঢাকায় আসার পর তিনি আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল এবং ইডেন কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
পারিবারিক জীবন
১৯৬৮ সালে শেখ হাসিনা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
রাজনৈতিক উত্থান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার বাবা-মা ও পরিবারের অধিকাংশ সদস্য নিহত হন। সে সময় তিনি জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন এবং পরবর্তীতে ভারতে আশ্রয় নেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং একই বছর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
রাজনৈতিক বিতর্ক ও সমালোচনা
তার শাসনামলে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, গুম, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটে তার ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেলেও, তার শাসনকাল গণতন্ত্র সংকোচনের জন্য সমালোচিত হয়েছে।
শেখ হাসিনাকে একাধিকবার বিশ্বের প্রভাবশালী নারী নেত্রী হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। তবে, তার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, যা তার নেতৃত্বকে বিতর্কিত করে তুলেছে।
শেখ হাসিনার পূর্নাঙ্গ জীবনী
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি চারবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ ছিল ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন, যখন আওয়ামী লীগ ১২ জুনের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পাশাপাশি তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা তখন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। পরবর্তী ছয় বছর তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে থাকেন এবং ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসন অবসানের জন্য শেখ হাসিনা নব্বইয়ের গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকে এবং তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তাঁর শাসনামলে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। এক বছরের কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে এবং ২০০৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং দারিদ্র্যের হার ৩৮.৪ শতাংশ থেকে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস করার মতো অর্জনগুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, এবং কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা তাঁর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শেখ হাসিনার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যকর করার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসের দায় মেটানোর উদ্যোগ নেন। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সবসময়ই কঠোর এবং আপোষহীন।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন, মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ এবং ৩২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জন তাঁর শাসনামলের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে স্থলসীমা চুক্তি এবং সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি কূটনৈতিক সাফল্যের মাইলফলক।
শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ইউনেস্কো তাঁকে “হুপে-বোয়ানি শান্তি পুরস্কার” প্রদান করেছে। এছাড়া তিনি "চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ", "ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার" এবং "গ্লোবাল ডাইভারসিটি পুরস্কার"সহ অসংখ্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
তাঁর শাসনামলে শিক্ষা খাতে বিপ্লব ঘটেছে। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ এবং প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় শতভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়নে শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।
- শেখ হাসিনার শাসনামলে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। তাঁকে নারী নেতৃত্বের অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৫ সালে উইমেন ইন পার্লামেন্টস গ্লোবাল ফোরাম তাঁকে "রিজিওনাল লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড" প্রদান করে।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জীবনেও রয়েছে গভীর ত্যাগের দৃষ্টান্ত। তাঁর স্বামী, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া, ২০০৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একমাত্র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ মনোবিজ্ঞানী। তিনি বাংলাদেশের অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী শেখ হাসিনা একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “শেখ মুজিব আমার পিতা”, “আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম” এবং “Miles to Go”। এই বইগুলো তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।
শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে একটি মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
- শেখ হাসিনার জীবন ও কর্ম বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর অসীম আত্মত্যাগ, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।