রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা কবিতা।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেস্ট কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কিছু কথা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, যিনি বাংলা কবিতাকে নতুন দিক ও মাত্রা দিয়েছেন। তিনি ১৮৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪১ সালে প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, দর্শন এবং মানবতার গভীর ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কবিতায় সহজ সরল ভাষার মাধ্যমে জটিল অনুভূতি এবং গভীর দার্শনিক চিন্তার মেলবন্ধন ঘটেছে।

প্রকৃতি ও মানবজীবন:
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং এর সঙ্গে মানবজীবনের সম্পর্ক গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর "সোনার তরী", "গীতাঞ্জলি" এবং "কান্নার কান্না" কবিতাগুলোতে প্রকৃতির বৈচিত্র্য এবং তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
প্রেম ও অনুভূতি:
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা অত্যন্ত আবেগময় এবং গভীর। "শেষের কবিতা", "গীতবিতান" এবং "কবিতা" গ্রন্থে প্রেমের নানাবিধ রূপ ফুটে উঠেছে – তা কখনো ব্যক্তিগত, কখনো আধ্যাত্মিক।

দর্শন ও মানবতা:
রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুধু প্রেম বা প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তাঁর কবিতায় মানবতার সুর, বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং জীবনবোধ বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। "গীতাঞ্জলি" কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা বাংলা সাহিত্যের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়।

সংগীত ও কবিতা:
রবীন্দ্রনাথের কবিতা সংগীতের সঙ্গে মিলে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে, যা রবীন্দ্রসংগীত নামে পরিচিত। তাঁর কবিতাগুলো শুধু পাঠের জন্য নয়, বরং গানের মাধ্যমে আবৃত্তি এবং পরিবেশনের জন্যও বিখ্যাত।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজও বাঙালির জীবন, সংস্কৃতি এবং মননে অমর হয়ে আছে।

প্রিয় পাঠক আজকে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেরা কবিতা কবিতাগুলো শেয়ার করতেছি।

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
     তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের 'পরে
                    পুচ্ছ নাচাতে।
     তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
     তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
          অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
              অবাধ যে তোর ধাওয়া;
          ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
              তোর যে দাবিদাওয়া।
 
যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
     মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
                    তুই যে শিকারি।
     মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
     অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
          বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
              মরণ-ঘোমটা টানি।
          সেই আবরণ দেখ্‌ রে উতারিয়া
              মুগ্ধ সে মুখখানি।
 
যৌবন রে, রয়েছ কোন্‌ তানের সাধনে।
     তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
                     পুঁথির বাঁধনে।
     তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
     অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
          তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
              ঝড়ের ঝংকারে;
     ঢেউয়ের 'পরে বাজিয়ে চলে বেগে
          বিজয়-ডঙ্কা রে।
 
যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
     বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
          হবে খণ্ডিতে।
     খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
     ছিন্ন করুক জরার কুজ্‌ঝটিকা,
     জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক'রে
              অমর পুষ্প তব
     আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
              ফুটুক নিত্য নব।
 
যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
     আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
                         রইবি কুণ্ঠিত?
     প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
     তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
          আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
              তোমার সে যে কবি।
          সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
              দেখে আপন ছবি।

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি


পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী।
     তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান
              রুদ্রের ভৈরব গান।
                  দূর হতে দূরে
          বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,
                  যেন পথহারা
              কোন্‌ বৈরাগীর একতারা।
 
              ওরে যাত্রী,
     ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;
চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি
         ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি
              দিগন্তের পারে দিগন্তরে।
     ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,
          নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,
          নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।
পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,
          শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।
     পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা,
     পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।
          নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।
 
     ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার।
          চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার--
     সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,
          নহে শান্তি, নহে সে আরাম।
          মৃত্যু তোরে দিবে হানা,
          দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,
     এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ
          ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী।
     ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী।
 
     পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী।
              এসেছে নিষ্ঠুর,
          হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,
          হোক রে মদের পাত্র চুর।
     নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,
          ধরো তার পাণি;
     ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী।
          ওরে যাত্রী
     গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি।

সোনার তরী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
     কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
            রাশি রাশি ভারা ভারা
            ধান কাটা হল সারা,
            ভরা নদী ক্ষুরধারা
                    খরপরশা।
     কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
     একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
     চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
            পরপারে দেখি আঁকা
            তরুছায়ামসীমাখা
            গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                    প্রভাতবেলা--
     এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
     গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
            ভরা-পালে চলে যায়,
            কোনো দিকে নাহি চায়,
            ঢেউগুলি নিরুপায়
                    ভাঙে দু-ধারে--
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
     বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
            যেয়ো যেথা যেতে চাও,
            যারে খুশি তারে দাও,
            শুধু তুমি নিয়ে যাও
                    ক্ষণিক হেসে
     আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
     যত চাও তত লও তরণী-'পরে।
     আর আছে?-- আর নাই, দিয়েছি ভরে।
            এতকাল নদীকূলে
            যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
            সকলি দিলাম তুলে
                    থরে বিথরে--
     এখন আমারে লহ করুণা করে।
     ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
            শ্রাবণগগন ঘিরে
            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
            শূন্য নদীর তীরে
                    রহিনু পড়ি--
     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

আমাদের ছোট নদী

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে 
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। 
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি, 
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি। 

চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, 
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। 
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক, 
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। 

আর-পারে আমবন তালবন চলে, 
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে। 
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে 
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে। 

সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে 
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে। 
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে, 
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে। 

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর 
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। 
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, 
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। 
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, 
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।

যেতে নাহি দিব

  দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
          হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
          জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
          মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
          ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
          ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
          ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম--
          শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
          গিয়েছে আশ্বিন-- পূজার ছুটির শেষে
          ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
          সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
          বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
          হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
          ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
          ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
          তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
          একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
          ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে
          যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, "এ কী কাণ্ড!
          এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
          বোতল বিছানা বাক্স  রাজ্যের বোঝাই
          কী করিব লয়ে  কিছু এর রেখে যাই
          কিছু লই সাথে।'
                          সে কথায় কর্ণপাত
          নাহি করে কোনো জন। "কী জানি দৈবাৎ
          এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
          তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে?
          সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান;
         ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
          গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল;
           দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল;
           আমসত্ত্ব আমচুর; সের দুই দুধ--
           এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ।
           মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে,
           মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।'
           বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়।
           বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
           তাকানু ঘড়ির পানে, তার পরে ফিরে
           চাহিনু প্রিয়ার মুখে; কহিলাম ধীরে,
           "তবে আসি'। অমনি ফিরায়ে মুখখানি
            নতশিরে চক্ষু-'পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
            অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন।
            বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
            কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
            অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
            দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
            মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
            দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
            নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
            ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
            চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
            বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
            বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
            চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
            "মা গো, আসি' সে কহিল বিষণ্ণ-নয়ন
            ম্লান মুখে, "যেতে আমি দিব না তোমায়।'
            যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায়,
            ধরিল না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার,
            শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
            প্রচারিল--"যেতে আমি দিব না তোমায়'।
            তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়
            যেতে দিতে হল।
                                ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
            কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
            কহিলি এমন কথা, এত স্পর্ধাভরে--
            "যেতে আমি দিব না তোমায়'? চরাচরে
            কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
            গরবিনী, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
            বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
            শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ।
            ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
            মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
            এ জগতে, শুধু বলে রাখা "যেতে দিতে
            ইচ্ছা নাহি'। হেন কথা কে পারে বলিতে
            "যেতে নাহি দিব'! শুনি তোর শিশুমুখে
            স্নেহের প্রবল গর্ববাণী, সকৌতুকে
            হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে,
            তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ'রে
            দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন,
            আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন।
             চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
             শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
             রৌদ্র পোহাইছে। তরুশ্রেণী উদাসীন
             রাজপথপাশে, চেয়ে আছে সারাদিন
             আপন ছায়ার পানে। বহে খরবেগ
             শরতের ভরা গঙ্গা। শুভ্র খণ্ডমেঘ
             মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
             সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
             নীলাম্বরে শুয়ে। দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
             যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
             ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস।
              কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
              সমস্ত পৃথিবী। চলিতেছি যতদূর
              শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
              "যেতে আমি দিব না তোমায়'। ধরণীর
              প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
              ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
              "যেতে নাহি দিব। যেতে নাহি দিব।' সবে
               কহে "যেতে নাহি দিব'। তৃণ ক্ষুদ্র অতি
               তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
               কহিছেন প্রাণপণে "যেতে নাহি দিব'।
               আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,
               আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
               কহিতেছে শত বার "যেতে দিব না রে'।
               এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
                সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
                গভীর ক্রন্দন--"যেতে নাহি দিব'।   হায়,
                তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
                চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে।
                প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
                প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
                "দিব না দিব না যেতে' ডাকিতে ডাকিতে
                হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
                পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
                সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
                "দিব না দিব না যেতে'-- নাহি শুনে কেউ
                নাহি কোনো সাড়া।
                                   চারি দিক হতে আজি
                 অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
                 সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
                 মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে; শিশুর মতন
                 বিশ্বের অবোধ বাণী। চিরকাল ধরে
                 যাহা পায় তাই সে হারায়, তবু তো রে
                 শিথিল হল না মুষ্টি, তবু অবিরত
                 সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
                 অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
                 "যেতে নাহি দিব'। ম্লান মুখ, অশ্রু-আঁখি,
                 দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব,
                 তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব,
                 তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
                 "যেতে নাহি দিব'। যত বার পরাজয়
               তত বার কহে, "আমি ভালোবাসি যারে
                 সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।
                 আমার আকাঙক্ষা-সম এমন আকুল,
                 এমন সকল-বাড়া, এমন অকূল,
                 এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর!'
                 এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
                 "যেতে নাহি দিব'। তখনি দেখিতে পায়,
                 শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
                 একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন;
                 অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন,
                 ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
                 হতগর্ব নতশির। তবু প্রেম বলে,
                 "সত্যভঙ্গ হবে না বিধির। আমি তাঁর
                 পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
                 চির-অধিকার-লিপি।'-- তাই স্ফীত বুকে
                 সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
                 দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
                 বলে, "মৃত্যু তুমি নাই।-- হেন গর্বকথা!
                 মৃত্যু হাসে বসি। মরণপীড়িত সেই
                 চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
                 অনন্ত সংসার, বিষণ্ণ নয়ন-'পরে
                 অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
                 চির-কম্পমান। আশাহীন শ্রান্ত আশা
                 টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
                 বিশ্বময়। আজি যেন পড়িছে নয়নে--
                 দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
                 জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে,
                 স্তব্ধ সকাতর। চঞ্চল স্রোতের নীরে
                 পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া--
                 অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্‌ মেঘের সে মায়া।
               তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
                 এত ব্যাকুলতা; অলস ঔদাস্যভরে
                 মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
                 শুষ্ক পত্র লয়ে; বেলা ধীরে যায় চলে
                 ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
                 মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
                 বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে; শুনিয়া উদাসী
                 বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
                 দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
                 একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
                 বক্ষে টানি দিয়া; স্থির নয়নযুগল
                 দূর নীলাম্বরে মগ্ন; মুখে নাহি বাণী।
                 দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
                 সেই দ্বারপ্রান্তে লীন, স্তব্ধ মর্মাহত
                 মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো।
 

এবারে ফাল্গুনের দিনে সিন্ধুতীরের কুঞ্জবীথিকায়

এবারে ফাল্গুনের দিনে সিন্ধুতীরের কুঞ্জবীথিকায়
          এই যে আমার জীবন-লতিকায়
ফুটল কেবল শিউরে-ওঠা নতুন পাতা যত
              রক্তবরন হৃদয়ব্যথার মতো;
দখিন হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে দিল কেবল দোল,
              উঠল কেবল মর্মর কল্লোল।
          এবার শুধু গানের মৃদু গুঞ্জনে
বেলা আমার ফুরিয়ে গেল কুঞ্জবনের প্রাঙ্গণে।
 
আবার যেদিন আসবে আমার রূপের আগুন ফাল্গুনদিনের কাল
          দখিন হাওয়ায় উড়িয়ে রঙিন পাল,
     সেবারে এই সিন্ধুতীরের কুঞ্জবীথিকায়
              যেন আমার জীবন-লতিকায়
                      ফোটে প্রেমের সোনার বরন ফুল
                            হয় যেন আকুল
              নবীন রবির আলোকটি তাই বনের প্রাঙ্গণে
                       আনন্দ মোর জনম নিয়ে
                            তালি দিয়ে তালি দিয়ে
                       নাচে যেন গানের গুঞ্জনে।

যে-কথা বলিতে চাই

যে-কথা বলিতে চাই,
         বলা হয় নাই,
             সে কেবল এই--
চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই
             দেখিনু সহস্রবার
             দুয়ারে আমার।
     অপরিচিতের এই চির পরিচয়
এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়
     সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী
          আমি নাহি জানি।
 
শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;
     নদীর এপারে ঢালু তটে
          চাষি করিতেছে চাষ;
     উড়ে চলিয়াছে হাঁস
ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে।
          চলে কি না চলে
        ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত
          আধো-জাগা নয়নের মতো।
          পথখানি বাঁকা
     বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা
চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,
     নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা।
 
ফাল্গুনের এ-আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,
              ওই খেয়াঘাট,
ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে
      নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে
          যেখানে বসায় মেলা-- এই সব ছবি
              কতদিন দেখিয়াছে কবি।
শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,
     এই আলো, এই হাওয়া,
এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,
     ভেসে-যাওয়া মেঘ হতে
     অকস্মাৎ নদীস্রোতে
          ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,
যে আনন্দ-বেদনায় এ জীবন বারেবারে করেছে উদাস
          হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ।
 

প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে

প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে।
সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে।
 
       আর-যাহারা আসে আমার ঘরে
       ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে,
           দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে,
               হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে।
 
সে এলে সব আগল যাবে ছুটে,
সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,
    ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে
        তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে।
 
       আসে যখন, একলা আসে চলে,
       গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে,
           সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে
               হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।

প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে

প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে।
সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে।
 
       আর-যাহারা আসে আমার ঘরে
       ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে,
           দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে,
               হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে।
 
সে এলে সব আগল যাবে ছুটে,
সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে,
    ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে
        তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে।
 
       আসে যখন, একলা আসে চলে,
       গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে,
           সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে
               হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।


পরশ-পাথর


খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
   মাথায় বৃহৎ জটা                 ধূলায় কাদায় কটা,
        মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
   ওষ্ঠে অধরেতে চাপি            অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
        রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
   দুটো নেত্র সদা যেন             নিশার খদ্যোত-হেন
        উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।
   নাহি যার চালচুলা            গায়ে মাখে ছাইধুলা
        কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন,
   ডেকে কথা কয় তারে        কেহ নাই এ সংসারে
        পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন,
   তার এত অভিমান,            সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান,
        রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর,
   দশা দেখে হাসি পায়          আর কিছু নাহি চায়
        একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!
        সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার।
   তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি                 হেসে হল কুটিকুটি
        সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার।
আকাশ রয়েছে চাহি,           নয়নে নিমেষ নাহি,
        হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে           পূর্ব গগনের ভালে,
        সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ।
জলরাশি অবিরল                 করিতেছে কলকল,
        অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।
কাম্য ধন আছে কোথা        জানে যেন সব কথা,
        সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি,        মহা গাথা গান গাহি
        সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।
কেহ যায়, কেহ আসে,        কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,
        খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।
        একদিন, বহুপূর্বে, আছে ইতিহাস--
নিকষে সোনার রেখা            সবে যেন দিল দেখা--
        আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ।
মিলি যত সুরাসুর                  কৌতূহলে ভরপুর
        এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে।
অতলের পানে চাহি                নয়নে নিমেষ নাহি
        নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে।
বহুকাল স্তব্ধ থাকি               শুনেছিল মুদে আঁখি
        এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন;
তার পরে কৌতূহলে           ঝাঁপায়ে অগাধ জলে
        করেছিল এ অনন্ত রহস্য মন্থন।
বহুকাল দুঃখ সেবি                নিরখিল, লক্ষ্মীদেবী
        উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর।
সেই সমুদ্রের তীরে                  শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ।
খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু          বিশ্রাম না জানে কভু,
        আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস।
বিরহী বিহঙ্গ ডাকে               সারা নিশি তরুশাখে,
        যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা।
তবু ডাকে সারাদিন              আশাহীন শ্রান্তিহীন,
        একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা।
আর-সব কাজ ভুলি            আকাশে তরঙ্গ তুলি
        সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত।
যত করে হায় হায়           কোনোকালে নাহি পায়,
        তবু শূন্যে তোলে বাহু, ওই তার ব্রত।
কারে চাহি ব্যোমতলে           গ্রহতারা লয়ে চলে,
        অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর।
সেইমতো সিন্ধুতটে                ধূলিমাথা দীর্ঘজটে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে,
"সন্ন্যাসীঠাকুর, এ কী,         কাঁকালে ও কী ও দেখি,
        সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।'
সন্ন্যাসী চমকি ওঠে               শিকল সোনার বটে,
        লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন।
একি কাণ্ড চমৎকার,            তুলে দেখে বার বার,
        আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন।
কপালে হানিয়া কর               বসে পড়ে ভূমি-'পর,
        নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা;
পাগলের মতো চায়--           কোথা গেল, হায় হায়,
        ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা।
কেবল অভ্যাসমত                  নুড়ি কুড়াইত কত,
        ঠন্‌ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,
চেয়ে দেখিত না, নুড়ি          দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,
        কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশ-পাথর।
        তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন।
আকাশ সোনার বর্ণ,              সমুদ্র  গলিত স্বর্ণ,
        পশ্চিম দিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।
সন্ন্যাসী আবার ধীরে               পূর্বপথে যায় ফিরে
        খুঁজিতে নূতন ক'রে হারানো রতন।
সে শকতি নাহি আর                 নুয়ে পড়ে দেহভার
        অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন।
পুরাতন দীর্ঘ পথ                 পড়ে আছে মৃতবৎ
        হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ।
দিক হতে দিগন্তরে               মরুবালি ধূ ধূ করে,
        আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ।
অর্ধেক জীবন খুঁজি              কোন্‌ ক্ষণে চক্ষু বুজি
        স্পর্শ লভেছিল যার এক পল ভর,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ              আবার করিছে দান
        ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশ-পাথর।
 

জীবন যখন শুকায়ে যায়


জীবন যখন শুকায়ে যায়
              করুণাধারায় এসো।
       সকল মাধুরী লুকায়ে যায়,
              গীতসুধারসে এসো।
 
                           কর্ম যখন প্রবল-আকার
                           গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার,
                           হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ,
                                  শান্তচরণে এসো।
 
       আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
       কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন,
       দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ,
              রাজ-সমারোহে এসো।
 
                                  বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
                                  অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়
                                  ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র,
                                         রুদ্র আলোকে এসো।


পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল; ওরে যাত্রী।
     তোমার পথের 'পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান
              রুদ্রের ভৈরব গান।
                  দূর হতে দূরে
          বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,
                  যেন পথহারা
              কোন্‌ বৈরাগীর একতারা।
 
              ওরে যাত্রী,
     ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;
চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে আবরি
         ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি
              দিগন্তের পারে দিগন্তরে।
     ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,
          নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,
          নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।
পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,
          শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ।
     পথে পথে কন্টকের অভ্যর্থনা,
     পথে পথে গুপ্তসর্প গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।
          নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।
 
     ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার।
          চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার--
     সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,
          নহে শান্তি, নহে সে আরাম।
          মৃত্যু তোরে দিবে হানা,
          দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,
     এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,
          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ
          ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী।
     ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষ্মী তোমার বরদাত্রী।
 
     পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি
          ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী।
              এসেছে নিষ্ঠুর,
          হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,
          হোক রে মদের পাত্র চুর।
     নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,
          ধরো তার পাণি;
     ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী।
          ওরে যাত্রী
     গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি।

প্রতীক্ষা


ওরে মৃত্যু, জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে
               বেঁধেছিস বাসা।
যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
               স্নেহ-ভালোবাসা,
গোপন মনের আশা,    জীবনের দুঃখ সুখ,
               মর্মের বেদনা,
চিরদিবসের যত    হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা
               বাসনা-সাধনা;
যেখানে নন্দন-ছায়ে নিঃশঙ্কে করিছে খেলা
               অন্তরের ধন,
স্নেহের পুত্তলিগুলি,আজন্মের স্নেহস্মৃতি,
               আনন্দকিরণ;
কত আলো, কত ছায়া, কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
               গীতিময়ী ভাষা--
ওরে মৃত্যু, জানিয়াছি, তারি মাঝখানে এসে
               বেঁধেছিস বাসা!
নিশিদিন   নিরন্তর   জগৎ    জুড়িয়া    খেলা,
               জীবন চঞ্চল।
চেয়ে   দেখি   রাজপথে  চলেছে  অশ্রান্তগতি
               যত পান্থদল;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে   পাখিগুলি  উড়ে   যায়
               প্রাণপূর্ণ বেগে,
সমীরকম্পিত    বনে    নিশিশেষে  নব   নব
               পুষ্প উঠে জেগে;
চারি দিকে  কত শত  দেখাশোনা  আনাগোনা
               প্রভাতে  সন্ধ্যায়;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে     খুলিতেছে জীবনের
               নূতন অধ্যায়;
তুমি শুধু এক প্রান্তে   বসে আছ অহর্নিশি
               স্তব্ধ নেত্র খুলি--
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা   উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া,
               বক্ষ উঠে দুলি।
যে    সুদূর    সমুদ্রের   পরপার-রাজ্য   হতে
               আসিয়াছ হেথা,
এনেছ  কি  সেথাকার     নূতন  সংবাদ   কিছু
               গোপন বারতা।
সেথা  শব্দহীন  তীরে  ঊর্মিগুলি তালে তালে
               মহামন্দ্রে বাজে,
সেই  ধ্বনি  কী  করিয়া  ধ্বনিয়া  তুলিছ  মোর
               ক্ষুদ্র বক্ষোমাঝে।
রাত্রি  দিন        ধুক ধুক    হৃদয়পঞ্জর-তটে
               অনন্তের ঢেউ,
অবিশ্রাম      বাজিতেছে   সুগম্ভীর   সমতানে
               শুনিছে না কেউ।
আমার   এ   হৃদয়ের  ছোটোখাটো  গীতগুলি,
               স্নেহ-কলরব,
তারি   মাঝে  কে  আনিল  দিশাহীন  সমুদ্রের
               সংগীত ভৈরব।
তুই  কি  বাসিস ভালো  আমার  এ  বক্ষোবাসী
               পরান-পক্ষীরে,
তাই এর পার্শ্বে এসে    কাছে বসেছিস ঘেঁষে
               অতি ধীরে ধীরে?
দিনরাত্রি   নির্নিমেষে   চাহিয়া  নেত্রের   পানে
               নীরব সাধনা,
নিস্তব্ধ    আসনে    বসি    একাগ্র   আগ্রহভরে
               রুদ্র আরাধনা।
চপল  চঞ্চল  প্রিয়া  ধরা   নাহি   দিতে   চায়,
               স্থির নাহি থাকে,
মেলি   নানাবর্ণ  পাখা  উড়ে  উড়ে  চলে  যায়
               নব নব শাখে;
তুই    তবু     একমনে   মৌনব্রত   একাসনে
               বসি নিরলস।
ক্রমে সে  পড়িবে  ধরা,  গীত  বন্ধ  হয়ে  যাবে
               মানিবে সে বশ।
  
তখন  কোথায়  তারে  ভুলায়ে  লইয়া  যাবি--
               কোন্‌ শূন্যপথে,
অচৈতন্য   প্রেয়সীরে   অবহেলে  লয়ে  কোলে
               অন্ধকার রথে!
যেথায়   অনাদি    রাত্রি  রয়েছে  চিরকুমারী--
               আলোক-পরশ
একটি  রোমাঞ্চরেখা  আঁকে নি  তাহার  গাত্রে
               অসংখ্য বরষ;
সৃজনের    পরপ্রান্তে   যে   অনন্ত  অন্তঃপুরে
               কভু দৈববশে
দূরতম     জ্যোতিষ্কের   ক্ষীণতম   পদধ্বনি
               তিল নাহি পশে,
সেথায়   বিরাট   পক্ষ   দিবি  তুই   বিস্তারিয়া
               বন্ধনবিহীন,
কাঁপিবে   বক্ষের    কাছে  নবপরিণীতা   বধূ
               নূতন স্বাধীন।
ক্রমে  সে  কি  ভুলে  যাবে  ধরণীর  নীড়খানি
               তৃণে পত্রে গাঁথা--
এ  আনন্দ-সূর্যালোক, এই  স্নেহ, এই  গেহ,
               এই পুষ্পপাতা?
ক্রমে  সে  প্রণয়ভরে  তোরেও  কি করে  লবে
               আত্মীয় স্বজন,
অন্ধকার  বাসরেতে   হবে   কি   দুজনে  মিলি
               মৌন আলাপন।
তোর   স্নিগ্ধ   সুগম্ভীর   অচঞ্চল  প্রেমমূর্তি,
               অসীম নির্ভর,
নির্নিমেষ    নীল   নেত্র,   বিশ্বব্যাপ্ত   জটাজূট,
               নির্বাক  অধর--
তার    কাছে   পৃথিবীর    চঞ্চল    আনন্দগুলি
               তুচ্ছ মনে হবে;
সমুদ্রে  মিশিলে   নদী   বিচিত্র  তটের   স্মৃতি
               স্মরণে কি রবে?
ওগো  মৃত্যু,  ওগো  প্রিয়,তবু থাক্‌  কিছুকাল
               ভুবনমাঝারে।
এরি    মাঝে      বধূবেশে     অনন্তবাসর-দেশে
               লইয়ো না তারে।
এখনো   সকল   গান   করে   নি   সে   সমাপন
               সন্ধ্যায় প্রভাতে;
নিজের   বক্ষের   তাপে   মধুর   উত্তপ্ত   নীড়ে
               সুপ্ত আছে রাতে;
পান্থপাখিদের  সাথে   এখনো   যে  যেতে  হবে
               নব নব দেশে,
সিন্ধুতীরে,    কুঞ্জবনে    নব    নব      বসন্তের
               আনন্দ-উদ্দেশে।
ওগো  মৃত্যু,  কেন  তুই   এখনি  তাহার  নীড়ে
               বসেছিস এসে?
তার   সব  ভালোবাসা   আঁধার   করিতে   চাস
               তুই ভালোবেসে?
এ   যদি   সত্যই    হয়    মৃত্তিকার   পৃথ্বী-'পরে
                 মুহূর্তের খেলা,
এই    সব   মুখোমুখি  এই     সব    দেখাশোনা
                 ক্ষণিকের মেলা,
প্রাণপণ    ভালোবাসা   সেও   যদি    হয়   শুধু
                  মিথ্যার বন্ধন,
পরশে   খসিয়া  পড়ে,   তার    পরে   দণ্ড-দুই
                 অরণ্যে ক্রন্দন--
তুমি   শুধু   চিরস্থায়ী,  তুমি  শুধু  সীমাশূন্য
                 মহাপরিণাম,
যত  আশা  যত  প্রেম  তোমার  তিমিরে  লভে
                 অনন্ত বিশ্রাম--
তবে  মৃত্যু,  দূরে যাও, এখনি দিয়ো না  ভেঙে
                 এ খেলার পুরী;
ক্ষণেক  বিলম্ব  করো,   আমার  দুদিন   হতে
                 করিয়ো না চুরি।
একদা   নামিবে   সন্ধ্যা,  বাজিবে   আরতিশঙ্খ
               অদূর মন্দিরে,
বিহঙ্গ   নীরব    হবে,   উঠিবে   ঝিল্লির    ধ্বনি
               অরণ্য-গভীরে,
সমাপ্ত   হইবে    কর্ম,     সংসার-সংগ্রাম-শেষে
               জয়পরাজয়,
আসিবে   তন্দ্রার   ঘোর   পান্থের   নয়ন'-পরে
               ক্লান্ত অতিশয়,
দিনান্তের  শেষ  আলো  দিগন্তে  মিলায়ে  যাবে,
               ধরণী আঁধার--
সুদূরে    জ্বলিবে    শুধু    অনন্তের   যাত্রাপথে
               প্রদীপ তারার,
শিয়রে   শয়ন-শেষে   বসি     যারা   অনিমেষে
               তাহাদের চোখে
আসিবে   শ্রান্তির    ভার   নিদ্রাহীন   যামিনীতে
               স্তিমিত আলোকে--
একে  একে  চলে  যাবে  আপন  আলয়ে  সবে
               সখাতে সখীতে,
তৈলহীন   দীপশিখা   নিবিয়া   আসিবে   ক্রমে
               অর্ধরজনীতে,
উচ্ছ্বসিত     সমীরণ    আনিবে    সুগন্ধ   বহি
               অদৃশ্য ফুলের,
অন্ধকার   পূর্ণ    করি    আসিবে   তরঙ্গধ্বনি
               অজ্ঞাত কূলের--
ওগো   মৃত্যু,  সেই  লগ্নে নির্জন  শয়নপ্রান্তে
               এসো বরবেশে।
আমার  পরান-বধূ ক্লান্ত  হস্ত প্রসারিয়া
               বহু ভালোবেসে
ধরিবে  তোমার  বাহু;   তখন  তাহারে  তুমি
               মন্ত্র পড়ি নিয়ো,
রক্তিম  অধর  তার   নিবিড়  চুম্বন দানে
               পাণ্ডু করি দিয়ো।

নিদ্রিতা

রাজার ছেলে ফিরেছি দেশে দেশে
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
যেখানে যত মধুর মুখ আছে
বাকি তো কিছু রাখি নি দেখিবার।
কেহ বা ডেকে কয়েছে দুটো কথা,
কেহ বা চেয়ে করেছে আঁখি নত,
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারো হাসি আঁখিজলেরই মতো।
গরবে কেহ গিয়েছে নিজ ঘর,
কাঁদিয়া কেহ চেয়েছে ফিরে ফিরে।
কেহ বা কারে কহে নি কোনো কথা,
কেহ বা গান গেয়েছে ধীরে ধীরে।
এমনি করে ফিরেছি দেশে দেশে।
অনেক দূরে তেপান্তর-শেষে
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে এসেছি দিয়ে মালা।
    একদা রাতে নবীন যৌবনে
স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
   বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার
ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।
   শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
পূর্বতটে হতেছে নিশি ভোর।
   আকাশ-কোণে বিকাশে জাগরণ,
ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।
   সমুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
দু-ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
   নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
আপন মনে ভাবিনু একবার--
   আমারি মতো আজি এ নিশিশেষে
   ধরার মাঝে নূতন কোন্‌ দেশে,
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।
   অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,
কত যে দেশ-বিদেশ হনু পার।
একদা এক ধূসর সন্ধ্যায়
ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার।
   সবাই সেথা অচল অচেতন,
কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,
   নদীর তীরে জলের কলতানে
ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি।
   ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,
নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে।
   প্রাসাদমাঝে পশিনু সাবধানে,
শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে।
   ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,
   কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা;
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,
ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা।
   কমলফুলবিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
   মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
   মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি
শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে;
   একটি বাহু বক্ষ-'পরে পড়ি,
একটি বাহু লুটায় এক ধারে।
   আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,
কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;
   পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি।
   দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি--
   ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
আপন ভরা-লাবণ্যে নিরালা।
   ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,
না মানে বাধা হৃদয়কম্পন।
   ভূতলে বসি আনত করি শির
মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন।
   পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,
তাহারি পানে চাহিনু একমনে,
   দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে।
   ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া
লিখিয়া দিনু আপন নামধাম।
   লিখিনু, "অয়ি নিদ্রানিমগনা,
আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম।"
   যতন করি কনক-সুতে গাঁথি
   রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি।
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা।
 

আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে


আমার একলা ঘরের আড়াল ভেঙে
                           বিশাল ভবে
                    প্রাণের রথে বাহির হতে
                           পারব কবে।
                    প্রবল প্রেমে সবার মাঝে
                    ফিরব ধেয়ে সকল কাজে,
                    হাটের পথে তোমার সাথে
                           মিলন হবে,
                    প্রাণের রথে বাহির হতে
                           পারব কবে।
 
                                         নিখিল আশা-আকাঙক্ষা-ময়
                                                দুঃখে সুখে,
                                         ঝাঁপ দিয়ে তার তরঙ্গপাত
                                                ধরব বুকে।
                                         মন্দভালোর আঘাতবেগে,
                                         তোমার বুকে উঠব জেগে,
                                         শুনব বাণী বিশ্বজনের
                                                কলরবে।
                                         প্রাণের রথে বাহির হতে
                                                পারব কবে।

মুক্তি


চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি',
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে?


আমার মনের জানলাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে


আমার মনের জানলাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে
          তোমার মনের দিকে।
সকালবেলার আলোয় আমি সকল কর্ম ভুলে
          রইনু অনিমিখে।
 
          দেখতে পেলেম তুমি মোরে
          সদাই ডাক যে-নাম ধ'রে
     সে-নামটি এই চৈত্রমাসের পাতায় পাতায় ফুলে
              আপনি দিলে লিখে।
     সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
               রইনু অনিমিখে।
 
     আমার সুরের পর্দাটি আজ হঠাৎ গেল উড়ে
              তোমার গানের পানে।
     সকালবেলার আলো দেখি তোমার সুরে সুরে
              ভরা আমার গানে।
              মনে হল আমারি প্রাণ
          তোমার বিশ্বে তুলেছে তান,
     আপন গানের সুরগুলি সেই তোমার চরণমূলে
              নেব আমি শিখে।
     সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে
              রইনু অনিমিখে।

ব্যর্থ যৌবন


আজি       যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
                    কেমনে?
কেন       নয়নের জল ঝরিছে বিফল
                    নয়নে!
            এ বেশভূষণ লহ সখী, লহ,
            এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ--
            এমন যামিনী কাটিল বিরহ
                    শয়নে।
আজি       যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
                    কেমনে।
আমি       বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে
                    এসেছি।
বহি         বৃথা মনোআশা এত ভালোবাসা
                    বেসেছি।
            শেষে নিশিশেষে বদন মলিন,
            ক্লান্ত চরণ, মন উদাসীন,
            ফিরিয়া চলেছি কোন্‌ সুখহীন
                 ভবনে!
হায়,      যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
                 কেমনে?
কত        উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
                 আকাশে!
বনে         দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল
                 বাতাসে।
            তরুমর্মর নদীকলতান
            কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান,
            দূর হতে আসি পশেছিল গান
                 শ্রবণে।
আজি       সে রজনী যায়, ফিরাইব তায়
                 কেমনে।
মনে        লেগেছিল হেন, আমারে সে যেন
                 ডেকেছে।
যেন        চিরযুগ ধরে মোরে মনে করে
                 রেখেছে।
            সে আনিবে বহি ভরা অনুরাগ,
            যৌবননদী করিবে সজাগ,
             আসিবে নিশীথে, বাঁধিবে সোহাগ-
                 বাঁধনে।
আহা,      সে রজনী যায়, ফিরাইব তায়
                 কেমনে।
ওগো,      ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে
                 মিছে আর?
যদি         যেতে হল হায়, প্রাণ কেন চায়
                  পিছে আর?
            কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো
            রজনীপ্রভাতে বসে রব কত!
            এবারের মতো বসন্ত গত
                  জীবনে।
হায়      যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
                  কেমনে।
 

বন্ধন

বন্ধন? বন্ধন বটে, সকলি বন্ধন--
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান। স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে--
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ, জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্‌ মুক্তিভ্রমে!


আজ এই দিনের শেষে


আজ এই দিনের শেষে
সন্ধ্যা যে ওই মানিকখানি পরেছিল চিকন কালো কেশে
          গেঁথে নিলেম তারে
এই তো আমার বিনিসুতার গোপন গলার হারে।
     চক্রবাকের নিদ্রানীরব বিজন পদ্মাতীরে
     এই সে সন্ধ্যা ছুঁইয়ে গেল আমার নতশিরে
              নির্মাল্য তোমার
              আকাশ হয়ে পার;
          ওই যে মরি মরি
তরঙ্গহীন স্রোতের 'পরে ভাসিয়ে দিল তারার ছায়াতরী;
          ওই যে সে তার সোনার চেলি
              দিল মেলি
          রাতের আঙিনায়
          ঘুমে অলস কায়;
         ওই যে শেষে সপ্তঋষির ছায়াপথে
              কালো ঘোড়ার রথে
     উড়িয়ে দিয়ে আগুন-ধূলি নিল সে বিদায়;
একটি কেবল করুণ পরশ রেখে গেল একটি কবির ভালে;
তোমার ওই অনন্ত মাঝে এমন সন্ধ্যা হয় নি কোনোকালে,
              আর হবে না কভু।
              এমনি করেই প্রভু
          এক নিমেষের পত্রপুটে ভরি
চিরকালের ধনটি তোমার ক্ষণকালে লও যে নূতন করি।
 

গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি


গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি
             বাহির মনে
চিরদিবস মোর জীবনে।
             নিয়ে গেছে গান আমারে
             ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে,
                   গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই
                         এই ভুবনে।
 
কত শেখা সেই শেখালো,
কত গোপন পথ দেখালো,
      চিনিয়ে দিল কত তারা
           হৃদ্‌গগনে।
               বিচিত্র সুখদুখের দেশে
               রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে
                     সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল
                           কোন্‌ ভবনে।


চিত্ত তোমায় নিত্য হবে

আমার চিত্ত তোমায় নিত্য হবে
সত্য হবে -
ওগো সত্য, আমার এখন সুদিন।
ঘটবে কবে।
সত্য সত্য সত্য জপি,
সকল বুদ্ধি সত্যে সঁপি,
সীমার বাঁধন পেরিয়ে যাব
নিখিল ভবে -
সত্য তোমার পূর্ণ প্রকাশ
দেখব কবে।

তোমায় দূরে সরিয়ে মরি
আপন অসত্যে।
কী যে কান্ড করি গো সেই
ভূতের রাজত্বে।
আমার আমি ধুয়ে মুছে
তোমার মধ্যে যাবে ঘুচে,
সত্য, তোমায় সত্য হব
বাঁচব তবে -
তোমার মধ্যে মরণ আমার
মরবে কবে।



কত অজানারে জানাইলে তুমি


কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই-
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।
পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে
মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন
সে কথা যে ভুলে যাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে
যখনি যেখানে লবে,
চির জনমের পরিচিত ওহে,
তুমিই চিনাবে সবে।
তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর,
নাহি কোন মানা, নাহি কোন ডর,
সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ-
দেখা যেন সদা পাই।
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

Post a Comment