হেলাল হাফিজের জীবনী।হেলাল হাফিজের কবিতা।হেলাল হাফিজের বিরহের কবিতা।হেলাল হাফিজের প্রেমের কবিতা

হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কবি এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি মূলত তার প্রেম, দ্রোহ, স্বাধীনতা, এবং মানবতার প্রতি গভীর অনুভূতিসম্পন্ন কবিতার জন্য খ্যাত। তার কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে।

জন্ম ও শৈশব

হেলাল হাফিজ ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার শৈশব এবং কৈশোরের অনেকটা সময় নেত্রকোনায় কাটিয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় স্কুল এবং কলেজে।

শিক্ষা

হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেখান থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে তার গভীর অনুরাগ বিকশিত করেন।

সাহিত্যকর্ম

হেলাল হাফিজ মূলত কবিতা লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "যে জলে আগুন জ্বলে" ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই গ্রন্থের "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" কবিতাটি তাকে বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এই কবিতাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য

হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম, বিরহ, দ্রোহ এবং স্বাধীনতার আবেগ গভীরভাবে ফুটে ওঠে। তার ভাষা সহজ, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ এবং পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি বিশেষত আধুনিক বাংলা কবিতায় একটি আলাদা ধারা সৃষ্টি করেছেন যা সহজ-সরল অথচ গভীরভাবে মনোমুগ্ধকর।

ব্যক্তিগত জীবন

হেলাল হাফিজ জীবনযাপন করেছেন সাধারণভাবে, কিন্তু তার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে মানব জীবনের অসাধারণ দিকগুলো।

পুরস্কার ও সম্মাননা

তার অসামান্য সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

সমকালীন প্রভাব

হেলাল হাফিজ এখনও তার কবিতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। নতুন প্রজন্মের পাঠক এবং কবিরাও তার কবিতা থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে।

মৃত্যু: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

  • হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, এবং মানবিক অনুভূতির গভীর প্রকাশ দেখা যায়। তার কবিতাগুলি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ এক বৈচিত্র্য যোগ করেছে। নিচে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:

হেলাল হাফিজের কবিতা

১. নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়

এটি হেলাল হাফিজের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাগুলোর একটি।

উদ্ধৃতি:

"এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।"

বিশ্লেষণ:

এই কবিতাটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে রচিত। এতে যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য। এটি মুক্তিযুদ্ধের একটি অমর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. এখন তুমি চিন্তা করো

উদ্ধৃতি:

"এখন তুমি চিন্তা করো, আমি দাঁড়াবো কোন্‌ দিকে,

নদীর উজান, নাকি ভাটিতে?"

বিশ্লেষণ:

এই কবিতায় প্রেমিক-প্রেমিকার মানসিক দ্বন্দ্ব এবং সিদ্ধান্তহীনতার এক সুন্দর চিত্রায়ন দেখা যায়। এটি প্রেম ও বেদনার এক অনন্য উদাহরণ।

৩. যে জলে আগুন জ্বলে

এই কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামের সঙ্গে সংযুক্ত এবং একাধিক স্তরে ব্যাখ্যা সম্ভব।

বিশ্লেষণ:

কবিতাটি প্রেম এবং দ্রোহের এক অপূর্ব মিশ্রণ। মানব জীবনের গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৪. চাঁদ মনে রেখো

উদ্ধৃতি:

"চাঁদ মনে রেখো, চাঁদ যেন ঢেকে না যায়

মেঘের আড়ালে।"

বিশ্লেষণ:

এই কবিতাটি প্রেমিকের প্রতি চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার এক কবিতা। এটি প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের গভীরতাকে তুলে ধরে।


নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়


এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

মিছিলের সব হাত

কন্ঠ

পা এক নয় ।


সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,

কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।

কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার


শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে

অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে

অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,

কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে

কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।


যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।

একটি পতাকা পেলে

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস

ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–‘পেয়েছি, পেয়েছি’।


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে

ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,

বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,

সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ

সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।

ফেরীঅলা

কষ্ট নেবে কষ্ট

হরেক রকম কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট!


লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট

পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,

আলোর মাঝে কালোর কষ্ট

‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট।


ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট

দাড়ির কষ্ট

চোখের বুকের নখের কষ্ট,

একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট।


প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট

অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,

ভুল রমণী ভালোবাসার

ভুল নেতাদের জনসভার

হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট।


দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট

পথের এবং পায়ের কষ্ট

অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট

কষ্ট নেবে কষ্ট।


আর কে দেবে আমি ছাড়া

আসল শোভন কষ্ট,

কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন

আমার মত ক’জনের আর

সব হয়েছে নষ্ট,

আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।

ইচ্ছে ছিলো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে

শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।


ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।


ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে

রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,

জন্মাবধি আমার শীতল চোখ

তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।


ইচ্ছে ছিল রাজা হবো

তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,

আজ দেখি রাজ্য আছে

             রাজা আছে

             ইচ্ছে আছে,

শুধু তুমি অন্য ঘরে।


নেত্রকোনা

কতো দিন তোমাকে দেখি না

তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোনা।


আমাকে কি চিনতে পেরেছো? আমি

ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক নিকট-আত্মীয়

আমাদের বড়ো বেশি মাখামাখি ছিলো,

তারপর কী থেকে কী হলো

আভাইগা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো।


দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোন দিন জিজ্ঞেস করো না

আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না

কী এমন অভিমানে আমাদের এতো ব্যবধান,

কতোটা বিশৃংখলা নিয়ে আমি ছিমছাম সন্নাসী হলাম।


কিছু কথা অকথিত থেকে যায়

বেদনার সব কথা মানুষ বলে না, রমনী-কাতর

সবিতা সেনের সূতী শাড়িও জানে না

সোনালী অনল আর কতো জল দিদির ভেতর।


কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?

কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?

তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।

মগড়ার ক্ষীণ কলরোল


অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,

তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,

যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে

জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।

পরানের পাখি

পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,

আমার সূর্যের কথা, কাঙ্খিত দিনের কথা,

সুশোভন স্বপ্নের কথাটা বলো,–শুনুক মানুষ।

পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,


অলক্ষ্যে কবে থেকে কোমল পাহাড়ে বসে

এতোদিন খুঁটে খুঁটে খেয়েছো আমাকে আর

কতো কোটি দিয়েছো ঠোকর,

বিষে বিষে নীল হয়ে গেছি, শুশ্রূষায়

এখনো কী ভাবে তবু শুভ্রতা পুষেছি তুমি দেখাও না

পাখি তুমি তোমাকে দেখাও,–দেখুক মানুষ।


পরানের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,

সময় পাবে না বেশি চতুর্দিক বড়ো টলোমলো

পরানের পাখি তুমি শেষবার শেষ কথা বলো,

আমার ভেতরে থেকে আমার জীবন খেয়ে কতোটুকু

যোগ্য হয়েছো, ভূ-ভাগ কাঁপিয়ে বেসামাল

কবে পাখি দেবেই উড়াল, দাও,–শিখুক মানুষ।

তুমি ডাক দিলে

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,

কতো হুলুস্থূল অনটন আজম্ন ভেতরে আমার।


তুমি ডাক দিলে

নষ্ঠ কষ্ঠ সব নিমিষেই ঝেড়ে মুছে

শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌছুবো


পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব

পথে এতোটুকু দেরিও করবো না।

তুমি ডাক দিলে

সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরোদ্যান হবো,

তুমি রাজি হলে

যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো।

একবার আমন্ত্রণ পেলে


সব কিছু ফেলে

তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল,

অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে

লোকালয়ে থাকবো না আর

আমরণ পাখি হয়ে যাবো, –খাবো মৌনতা তোমার।

প্রস্থান

এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।


আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই।

গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?

আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,

নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে

পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?

আমার সকল আয়োজন

আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?

কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,

দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের

একমাত্র মৌলিক কাহিনী।

আমার শৈশব বলে কিছু নেই

আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,

আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।

দুঃখ তো আমার হাত–হাতের আঙুন–আঙুলের নখ

দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।

আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই,

দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয়, যে আমাকে দুঃখ দেবে।

আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,

অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,

পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে

সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফ্টি-ম্যাচের মতো বুকে।

দুঃখের আরেক নাম

আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।

অলৌকিক কিছু নয়,

নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি

তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার।

আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে,

পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে।

নারী তুমি আমার ভিতরে হও প্রবাহিত দুর্বিনীত নদীর মতন,

মিলেমিশে একাকার হয়ে এসো বাঁচি

নিদারুণ দুঃসময়ে বড়ো বেশি অসহায় একা পড়ে আছি।

তুমুল ফাল্গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,

আকস্মিক দু’একটা কুহু কুহু আর্তনাদ

পৃথিবীকে উপহাস করে।

একদিন কোকিলেরো সুসময় ছিলো, আজ তারা

আমার মতোই বেশ দুঃসময়ে আছে

পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে।

এখন তুমিই বলো নারী

তোমার উদ্যান ছাড়া আমি আর কোথায় দাঁড়াবো।

আমাকে দাঁড়াতে দাও বিশুদ্ধ পরিপূর্ণতায়,

ব্যাকুল শুশ্রুষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো

নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ,

এতোদিন নারী ও রমনীহীন ছিলাম বলেই ছিলো

দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।

ইচ্ছে ছিলো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে

শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।

ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে

রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,

জন্মাবধি আমার শীতল চোখ

তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।

ইচ্ছে ছিল রাজা হবো

তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,

আজ দেখি রাজ্য আছে

রাজা আছে

ইচ্ছে আছে,

শুধু তুমি অন্য ঘরে।

হিরণবালা

হিরণবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন

যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।

ফুলের কাছে মৌমাছিরা

বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী

খোদার কসম হিরণবালা

তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমনি ঋণী।

তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ

তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ

যৌবনে এই তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ

এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে

কিছু সময় ছিলো বলেই সভ্য হলো

মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।

আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার

আঙুলে আজ সুর এসেছে,

নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ

তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?

যাতায়াত

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না

রাত কাটে তো ভোর দেখি না

কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম

পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,

কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো

যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি

মাথার কসম আবার এসো

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো

শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,

চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি

বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়

আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।

কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

যেভাবে সে এলো

অসম্ভব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছিলো,

সামনে যা পেলো খেলো,

যেন মন্বন্তরে কেটে যাওয়া রজতজয়ন্তী শেষে

এসেছে সে, সবকিছু উপাদেয় মুখে।

গাভিন ক্ষেতের সব ঘ্রাণ টেনে নিলো,

করুণ কার্নিশ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা লকলকে লতাটিও খেলো,

দুধাল গাভীটি খেলো

খেলো সব জলের কলস।

শানে বাধা ঘাট খেলো

সবুজের বনভূমি খেলো

উদাস আকাশ খেলো

কবিতার পান্ডুলিপি খেলো।

দু’পায়া পথের বুক, বিদ্যালয়

উপাসনালয় আর কারখানার চিমনি খেলো

মতিঝিলে স্টেটব্যাংক খেলো।

রাখালের অনুপম বাঁশিটিকে খেলো,

মগড়ার তীরে বসে চাল ধোয়া হাতটিকে খেলো

স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না।

উৎসর্গ

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো

আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?

কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?

কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো

চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,

তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে

খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে

কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।

মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,

সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,

তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,

নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–

পথিক এ পথে নয়

‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো

আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

শামুক

‘অদ্ভুত, অদ্ভুত’ বলে

সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন কিছু লোক।

আমি নগরের জ্যেষ্ঠ শামুক

একবার একটু নড়েই নতুন ভঙ্গিতে ঠিক গুটিয়ে গেলাম,

জলে দ্রাঘিমা জুড়ে

যে রকম গুটানো ছিলাম,

ছিমছাম একা একা ভেতরে ছিলাম,

মানুষের কাছে এসে

নতুন মুদ্রায় আমি নির্জন হলাম,

একাই ছিলাম আমি পুনরায় একলা হলাম।

Post a Comment