বিজয় দিবস আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের এক অমলিন অধ্যায়। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই সব বীর সন্তানদের, যাঁরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। বিজয়ের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁদের রক্তের অক্ষরে লেখা আমাদের এই স্বাধীনতা।
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?"
যদিও এটি ভাষা আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি, তবুও এর গভীরতর অর্থ বিজয়ের চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে। বিজয় দিবসে এই অনুভূতিই আমাদের উদ্দীপিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ এক সোনার বাংলা গড়তে।আজকে আমরা বিজয় দিবসের সেরা কবিতা পড়বো।
কবি নির্মলেন্দু গুণ - স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি – কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ……।
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশুপার্কের রঙ্গিন দোলনায় দোল খেতে খেতে – তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান- এসবের কিছুই ছিলনা,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সে দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল – দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যূ, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত – করুণ কেরাণী – নারী – বৃদ্ধ – বেশ্যা – ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু – পাতা কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে – জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূয্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
রক্তরঙের ছবি
হাসান হাফিজ
রক্তপিছল পথ পেরিয়ে
তোমাকে ছুঁই স্বাধীনতা
তুমি আমার প্রাণের মর্ম
আত্মীয় সুখ বিয়োগব্যথা।
শোষণ-পীড়ন জেল জুলুমে
শৃঙ্খলিত বন্দি থেকে
রক্তরঙে তোমার ছবি
মানসপটে নিপুণ এঁকে
হই গেরিলা অস্ত্র ধরি
মাতৃভূমি স্বাধীন করি
লাল সবুজের এই পতাকা
রক্তদামে ছিনিয়ে আনি
স্বাধীনতার সত্য পথে
লাখ শহীদান অমর জানি
সময়ের মূল্য
রুস্তম আলী
এক মিনিটের অবজ্ঞায় দেহের একটি অঙ্গ গুড়িয়ে যেতে পারে,
একটা জীবনও চলে যেতে পারে অকালে।
তেমনি এক মিনিটের নিমিত্ত দুর্ঘটনা থেকে একটি
মানুষ ফিরে পেতে পারে দেহের একটি অঙ্গ
কিংবা অকাল মৃত্যুর হাত থেকে পুনর্জীবন।
আসলে আমরা এতটাই বিজ্ঞ যে, অর্থ-সম্পদ বাড়ি-গাড়ি
জমি-জায়গা সব কিছুরই মূল্য বুঝি
কিন্তু সময়ের মূল্য বুঝি না।
বিজয় দিবস
মাশায়েখ হাসান
৭১’এর এই দেশেতে
হানাদার হানা দেয়।
দেশকে স্বাধীন করতে বাঙ্গালী
অস্ত্র তুলে নেয়।
৭১’এর এই দিনেতে
হয় সীমাহীন যুদ্ধ।
যার কাহিনী শুনলে মোদের
শ্বাস হয়ে যায় রুদ্ধ।
৩০ লক্ষ শহীদ আর
মা-বোনের বিনিময়।
স্বাধীন বাংলাদেশ এর ঘটে
উদার অভ্যূদয়।
পাগলী মা’টা
জনি হোসেন
ফিরে এল বিজয় দিবস
নেইতো খোকা ঘরে,
সেই যে গেল আর এলোনা
যুদ্ধে একাত্তরে।
স্বপ্ন বোনে পাগলী মা’টা
ফিরবে খোকা কবে,
ফুলেল মালা গলে দিবে
ফুল ঝরে যায় টবে।
ছেলে আসবে,আসবে ছেলে
পাগলী মা’টা চ্যাঁচায়,
পাগলী মা’টা রুক্ষ সুক্ষ
যত্ন নিতে কে চায়?
প্রতিবারে বছর শেষে
বিজয় যখন আসে,
ছেলে হারা পাগলী মা’টা
দাঁত খিলিয়ে হাসে।
ডিসেম্বর এলেই
আফজাল হোসেন।
ডিসেম্বর এলেই বাংলার আকাশে বাতাসে
ভেসে বেড়ায় আতর -গোলাপ আর
আগর বাতির ধোঁয়ায় উড়া সুঘ্রাণের
মতো লাশের সুবাস।
উনিশশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে
পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ও তার
দোসরদের হাতে নিহত বীর বাঙ্গালী
মানুষের লাশ! শিশুর লাশ! বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ!
যুবক-যুবতীর লাশ! হাতে মেহেদী পরা কিংবা
কপালে টিপ সিঁদুর দেয়া নবদম্পতির লাশ!
হিন্দুর লাশ!মুসলমানের লাশ!বৌদ্ধের লাশ!
খ্রীস্টানের লাশ!গুলি করে মারা অজস্র
মানুষের লাশ! বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে
মারা মানুষের লাশ!সারি বদ্ধ ভাবে
দাঁড় করিয়ে মেশিন গানের গুলিতে মেরে
ফেলা মানুষের লাশ!বোমা মেরে মারা
মানুষের লাশ!পাশবিক অত্যাচার নির্যাতন করে
মারা মানুষের লাশ!শরীরের প্রতিটি
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে
কেটে বিকৃত করা মানুষের লাশ! লড়াই করে
জীবন দেয়া শহীদের লাশ!লাশ, লাশ!
দুই লাখ ত্রিশ হাজার বাঙ্গালির লাশে
পুরো বাংলাদেশটাই হয়ে যায় লাশের বধ্যভূমি।
তাইতো ডিসেম্বর এলে ঘুম হয়না আমাদের
কারো!যেখানে সেখানে তাই
মঞ্চ বানিয়ে "একান্তরের মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বাস্তবায়নের "জ্বালাময়ী বক্তব্যে
দিয়ে টালমাটাল করি আমরা! আমাদের
দেশ বরেণ্য শিল্পীদের দেশাত্ববোধক
গানে গানে হয় মুখরিত সারা বাংলাদেশ।
কবিরা নতুন কবিতা লেখে,শহীদ স্বরণীকা
প্রকাশের ধুম পড়ে যায় সারাটা ডিসেম্বর জুড়ে।
রাষ্ট্রীয়ভাবেও আয়োজন করা হয় জমকালো
বিজয় অনুষ্ঠানর। ডিসেম্বর শেষেই
এসে যায় নতুন বছর; আমরা ভুলে যাই তখন
পুরোনো সব শোকগাথা আর প্রতিশ্রুতি ।
কবিদেরও বন্ধ হয়ে যায় ডিসেম্বরের
বিজয় দিবস নিয়ে নতুন কবিতা লেখা।
একাত্তরের চেতনার সুউচ্চ কন্ঠস্বর
ক্রমশ নিচু হতে হতে আতর -সুবাস
আর আগরবাতির সুঘ্রাণের মতোই
হাওয়ায় মিশিয়ে যায়! বাঙ্গালী আমরা
আবার নতুনকরে নতুন বছরের নতুন
বিজয় দিবস পালনের প্রস্ততি নিতে থাকি!
এক, দুই, তিন এভাবে ক্রমান্বয়ে বিগত
তিপান্ন বছর ধরেই আমরা ষোলই ডিসেম্বর
'মহান বিজয় দিবস ' পালন করে আসছি।
যদিও প্রতিটি বিজয় দিবসের আলোচনাতেই
" একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন "
হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ!!
শত অনুভূতির বিজয়
গণেশ পাল
আমাদের এ বিজয়
শত অনুভূতির বিজয় এখন ----
পুরনো হতাশা আর নয় ।
নতুন সূর্য এখন রাঙিয়ে দেবে
বন-প্রান্তর এক বুক আকাশ ---
সব সব কথা এই আকাশেই তবে
হয়ে যাক বিজয়ের পতাকা ।
পতাকা উড়ছে মুক্ত হাওয়ায় ,
পতাকা আজীবন মুক্ত কন্ঠ ,
পতাকা উড়বে সারা বাংলায় ,
পতাকা পরম্পরা , পরম্পরায় আমাদের
পতাকা মিছিলের বিজয় ।
বিজয় দিবসের অভিনন্দন
নমিতা ঘোষ
--------
শত্রুর বুলেটের খোঁচায়
ঝড়লো কত রক্তবিন্দু -
সবুজ ঘাসের পরে ,
আজ তোমাদের জানাই স্যালুট
বিজয় মাসের এই দিনে।
গর্জে উঠেছিল বাংলার আওয়াজ
বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ স্বরে ,
যোগ দিয়েছিল কাতারে কাতারে
আবাল বৃদ্ধ বনিতা একযোগে
অভিনন্দন জানাই তোমায় করজোড়ে।
বিজয়-আহবান
সুমাইয়া তাওহীদ মালিক
মা মা তোর করুণদশা
চোখে আসে জল,
তোকে নিয়ে করছে খেলা
দুষ্ট পাপির দল।
নামেই কেবল স্বাধীন হলি
কিন্তু কী স্বাধীন!
পরাধীনের যাঁতাকলে
বাঁচাটা কঠিন।
তবে কেন ঝরল মা-তোর
লক্ষ তাজা প্রাণ!
দেশপ্রেমিকের আত্মরোদন
শহিদ, গাজি ম্লান__
আর কতদিন সইবি মা-গো
এমন নিঠুর জ্বালা-
আবারো কী হবি মা-তুই
রক্তে লালে লালা!
আবার জাগবে বীরসেনারা
সাজাবে এই মাকে,
একাত্তরের বিজয়-সাজে
দেখব আবার তাকে...
দেখা দিয়ো
মাহমুদ শফিক
যদি ঘুমের মধ্যে সারস হয়ে
উড়ে যাও তুমি শীতের দেশে,
যদি আমি পড়ে থাকি একা,
পোকামাকড় খেয়ে ফেলে আমার
সমস্ত শরীর,
শয্যায় পড়ে থাকে হাড়গোড়,
তখন কি আমাকে চিনতে
পারবে তুমি?
আমি মাছ হয়ে চলে যাবো
সমুদ্রে,
ধরা দেবো জেলের জালে,
সে রেখে যাবে আমার কঙ্কাল
সমুদ্রের তটে,
তুমি সিন্ধু ঈগল হয়ে দেখা দিও।
--------------------
আরো দেখুন: Bijoy Converter