বিপ্লবী সরকার কি।বিপ্লবী সরকার কাকে বলে।বিপ্লবী সরকার মানে কি।বিপ্লবী সরকারের বৈশিষ্ট্য

বিপ্লবী সরকার বলতে বোঝানো হয় এমন একটি সরকার, যা প্রচলিত রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন বা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। এটি সাধারণত প্রচলিত শাসনের পতনের পর গঠিত হয় এবং নতুন আদর্শ বা ব্যবস্থার প্রবর্তনে কাজ করে।

বিপ্লবী সরকারের বৈশিষ্ট্য:
  • প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পতন – বিদ্যমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে।
  • নতুন আদর্শের প্রবর্তন – সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ বা অন্য কোনো আদর্শের ভিত্তিতে নতুন শাসন কাঠামো গঠন করা হয়।
  • গণআন্দোলনের ফসল – বিপ্লবী সরকার সাধারণত জনসাধারণের বৃহৎ অংশের অংশগ্রহণ ও সমর্থনে গড়ে ওঠে।
  • প্রচলিত আইন ভাঙার প্রবণতা – পুরনো আইন ও প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে নতুন কাঠামো গঠন করা হয়।
  • সশস্ত্র সংগ্রাম বা শক্তির ব্যবহার – অনেক ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিদ্রোহ বা সামরিক শক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • বিরোধীদের দমন – নতুন শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবী সরকার প্রায়ই বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
  • নতুন অর্থনৈতিক নীতি – সম্পদের পুনঃবণ্টন, রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতি বা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
  • আন্তর্জাতিক প্রভাব – বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে এবং অন্য দেশগুলোর বিপ্লবে উদ্দীপনা জোগায়।

বিপ্লবী সরকার কখন গঠিত হয়?

  • সামাজিক বা অর্থনৈতিক অসন্তোষ – চরম দারিদ্র্য, বেকারত্ব বা বৈষম্য থেকে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়।
  • রাজনৈতিক দুর্বলতা – দুর্নীতি, স্বৈরশাসন বা প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে সরকার অকার্যকর হয়ে পড়ে।
  • যুদ্ধ বা সামরিক পরাজয় – যুদ্ধ বা সামরিক ব্যর্থতা বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি করে।
  • গণআন্দোলন ও প্রতিবাদ – দীর্ঘ আন্দোলন ও অসন্তোষ প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটায়।
  • বহিরাগত প্রভাব – বিদেশি শক্তির সহায়তায় বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
  • স্বৈরাচারী শাসন – জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ হলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

বিপ্লবী সরকারের কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ:

১. ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)
সরকার: ন্যাশনাল কনভেনশন এবং পরবর্তীকালীন জ্যাকোবিন সরকার
বৈশিষ্ট্য:
  • ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
  • রোবেসপিয়েরের নেতৃত্বে "ভয়াবহ শাসন (Reign of Terror)" চালু হয়, যেখানে বিপ্লববিরোধীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়।
  • সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শের প্রচলন ঘটে।
২. রুশ বিপ্লব (১৯১৭)
সরকার: বলশেভিক সরকার (ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে)
বৈশিষ্ট্য:
  • জার শাসনের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
  • জমির জাতীয়করণ এবং কলকারখানার শ্রমিকদের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়।
  • লাল বাহিনী (Red Army) গঠন করে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে বিরোধীদের পরাজিত করা হয়।
৩. কিউবান বিপ্লব (১৯৫৯)
সরকার: ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবী সরকার
বৈশিষ্ট্য:
  • ফিদেল কাস্ত্রো এবং চে গেভারার নেতৃত্বে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটে।
  • মার্কসবাদী আদর্শে পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • জমি সংস্কার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।
৪. চীনা বিপ্লব (১৯৪৯)
সরকার: চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মাও সেতুং-এর সরকার
বৈশিষ্ট্য:
  • চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন কুওমিনতাং সরকারকে পরাজিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠন করা হয়।
  • ভূমি সংস্কার ও কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিবর্তন আনা হয়।
৫. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার (১৯৭১)
সরকার: মুজিবনগর সরকার (প্রবাসী সরকার)
বৈশিষ্ট্য:
  • পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এই সরকার গঠিত হয়।
  • মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
  • স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেয় এবং নতুন সংবিধানের ভিত্তি গড়ে।
৬. ইরানি বিপ্লব (১৯৭৯)
সরকার: আয়াতুল্লাহ খোমেইনির ইসলামিক বিপ্লবী সরকার
বৈশিষ্ট্য:
  • ইরানের শাহ শাসনের পতন ঘটিয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • ইসলামী আইন (শরিয়াহ) অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রভাব থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা চলে।
এই বিপ্লবীগুলো বিভিন্ন আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, কিন্তু সবগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পতন এবং নতুন আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা।

Post a Comment