কুমারী পূজা কি? কুমারী পূজা নিয়ে রচনা। কুমারী পূজা নিয়ে অনুচ্ছেদ। কুমারী পূজা প্রবন্ধ। কুমারী পূজা ইতিহাস

কুমারী পূজা
মোহাম্মাদ জাহিদ হোসেন

কুমারী পূজা নিয়ে একটু বলা যাক।

১১ অক্টোবর কুমারী পুজো শুরু হবে সকাল ৯টা থেকে। তখনই এই পুজো করে নিতে হবে। কন্যা পুজোতে ২ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কুমারী মেয়েদের পুজো করা হয়। কমপক্ষে ৯ জন কন্যাকে এই পুজোয় বসাতে হয়। এরপর সেই কন্যাদের পুজো করে প্রসাদ নিবেদন করতে হয়। 

মহাষ্টমীতে মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমীব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা ও বলিদান। বৃহদ্ধর্মপুরাণের মতে, দেবী চন্ডিকা এক কুমারী কন্যারূপেই দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। 

দেবী ভগবতী কুমারীরূপেই আখ্যায়িত। কুমারী পূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় । 

তাকে সাজানো হয় ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলঙ্কারে। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে ফুলের বাজুবন্ধ, কুমারী মেয়েটি যেন সত্যিই দেবীর প্রতিরুপ। মন্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার।

কুমারী দেবীর কাছে ভক্তদের মিনতি,

‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াত্’ অর্থাৎ , হে দুর্গা, তুমি কন্যা ও কুমারী। আমরা কাত্যায়নকে জানব। 

সেজন্য তোমাকে ধ্যান করি। তুমি আমাদের শুভ কাজে প্রেরণা দাও।

ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।

এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা

দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী

তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি

চার বছরের কন্যা — কালিকা

পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা

ছয় বছরের কন্যা — উমা

সাত বছরের কন্যা — মালিনী

আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা

নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা

দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা

এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী

বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী

তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী

চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা

পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা

ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা।

কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। 

পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃ্প পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।

তবে সব পূজা মন্ডপে কুমারী পূজার চল নেই। বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতে শুধু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পূজামন্ডপগুলোতে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

কুমারীকে অর্চনার মন্ত্রঃ

কুমারীকে অর্চনা করতে করতে পুরোহিত গদগদ কণ্ঠে ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করে বলবেন—

ওঁ কুমারীং কমলারূঢ়া ত্রিনেত্রাং চন্দ্রশেখরাম্।

তপ্ত কাঞ্চন বর্ণাভাং নানালঙ্কার ভূষিতাম্।

রক্তাম্বর পরিধানাং রক্তমাল্য অনুলেপনা।বামেন অভয়দাং ধ্যায়ে দক্ষিণেন বরপ্রদাম্।

—অর্থাৎ যিনি পদ্মাসীনা লক্ষ্মীস্বরূপা, ত্রিনেত্রা, যাঁরা মাথায় চন্দ্রকলা শোভা পাচ্ছে, যার বর্ণতপ্তকাঞ্চনতুল্য, যিনি নানা অলংকারে ভূষিতা, যিনি রক্তবস্ত্র ও রক্তমাল্য পরিহিতা, যাঁর দেহরক্ত ও চন্দনাদির দ্বারা অনুলিপ্ত, যাঁর বাম হাত অভয় মুদ্রা ও ডান হাত বর প্রদানে প্রসারিত সেই কুমারীকে আমরা ধ্যান করি।

আবার অন্য একটি ‘তন্ত্রের ধ্যানমন্ত্রে আছে—

বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবৰ্ণিনীম্।

নানালঙ্কার নাঙ্গীং ভদ্রবিদ্যা প্রকাশিনীম্।

চারুহাস্যাং মহানন্দ হৃদয়ং শুভদাং শুভাম্।

ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিণীম্।

—অর্থাৎ যিনি তিন ভুবনের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং শোভন বর্ণধারিণী— সামনে উপস্থিত এই বালিকা মূর্তি, এঁর নানা অঙ্গে বিভিন্ন রকমের অলংকার থাকায় এঁর দেহটি ঈষৎ অবনত অবস্থায় আছে; ইনি অধিকারী বলে বিবেচিত হন। অতঃপর কুমারীকে ভক্তি ভরে প্রদক্ষিণ ও দক্ষিণা প্রদান করে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করে বলতে হয়—

নমামি কুলকামিনীং পরমভাগ্য সন্দায়িনীং।

কুমার-রতি-চাতুরীং সকলসিদ্ধি-মানন্দিনীম্।

প্রবাল-গুটি-কাস্রজং রজতরাগ বস্ত্রান্বিতাং।

হিরণ্যতুলা-ভূষণাং ভুবনবাক্ কুমারীং ভজে।

—অর্থাৎ হে কুলকামিনী, অতুল সৌভাগ্যদাত্রী, কুমার কার্তিকের মনে আনন্দ সঞ্চারিণী, সকল সিদ্ধিদাত্রী ও আনন্দবিধায়িনী দেবী কুমারী তোমায় প্রণাম জানাই। তুমি প্রবালখণ্ডের মালা, রুপো ও রঞ্জিত বস্ত্র এবং স্বর্ণতুল্য ভূষণে অলংকিতা আছো, হে দেবী— তোমাকে ভজনা করি। তাছাড়া দেবীর একটি অন্য স্তব ও প্রণাম মন্ত্র আছে—

ওঁ আয়ুর্বলং যশো দেহি, ধনং দেহি কুমারীকে।

সর্বং সুখং চ মে দেহি, প্রসীদ পরমেশ্বরী।

ব্রাহ্মী মাহেশ্বরী রৌদ্রী রূপত্ৰিতয়ধারিণী।

অভয়ঞ্চ বরং দেহি, নারায়ণি নমোহস্তুতে।

—হে দেবী কুমারী, তুমি আমাদের আয়ু, বল, যশ, ধন ও সকলপ্রকার সুখ প্রদান করো। তুমি আমাদের সকলের প্রতি প্রসন্না হও। হে দেবী— তুমি ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী ও রৌদ্রারূপী ধারণ করে। আমাদের অভয় ও বরদান করো। হে নারায়ণী, তোমাকে নমস্কার করি।

তথ্যসূত্র:-

1. দুলাল ভৌমিক (সম্পাদক)। "কুমারী পূজা"। বাংলাপিডিয়া। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ।

2.কুমারীপূজাপ্রযে়াগ। ঢাকা: বাংলা একাডেমী সংগ্রহ- ১৫৯। লিপিকাল ১৮৫০।

3."কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত"। দৈনিক যুগান্তর। অক্টোবর ১৩, ২০১৩। সংগৃহীত জুন ২৫, ২০১৪।


Post a Comment