সবচেয়ে সুন্দর কবিতা।সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা।বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবিতা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

 


বাংলা কবিতার ইতিহাস একটি সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। এটি প্রাচীন সময় থেকে শুরু হয়ে মধ্যযুগ, নবজাগরণ এবং আধুনিক যুগে প্রবাহিত হয়েছে।

প্রাচীন কাল:বাংলা কবিতার সূচনা ঘটে ৮ম শতাব্দীতে, যখন বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল। "চন্ডীমঙ্গল" ও "মানসী কবিতা" এর উদাহরণ।

মধ্যযুগ:১২শ শতাব্দীর পরে বাংলা কবিতা অধিক উন্নত হয়। কবি ও নবী এলিয়াস, চণ্ডীদাস, এবং রাধারমন দে এর মতো কবিরা আমাদের কবিতার ভাণ্ডার বাড়িয়েছেন। ভক্তিগীতি, বা মহাকাব্যিক কাব্যের উদ্ভব ঘটে।

নবজাগরণ:১৯শ শতাব্দী বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নতুন রূপ নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম মতো কবিরা বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। রবীন্দ্রনাথের "গীতাঞ্জলি" বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ হয়। 

আধুনিক যুগ:২০শ শতাব্দীতে কবিতার আধুনিকীকরণ ঘটে। বিভিন্ন স্রোত ও ধারার উন্মোচন হয়, যেমন, সামাজিক সমস্যা, প্রেম, মানবিক আবেগ। কবি সৃষ্টিকর্তা ও অন্যান্য মৌলিক বিষয়বস্তুতে কবিতা রচনা করেন।

বর্তমান পরিস্থিতি:আজকাল বাংলা কবিতা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কবিরা তাদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরছেন নতুন ধাঁচে।

বাংলা কবিতার ইতিহাসের প্রতিটি পর্ব আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন, যা বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হয়েছে। এটি আমাদের ঐতিহ্যকে জাগরণ করে, নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।আজকে আমরা সেরা কবিতাগুলো পড়বো বাংলা সাহিত্যের...

প্রশ্ন
আবুল হাসান


চোখ ভরে যে দেখতে চাও

রঞ্জন রশ্মিটা চেনো তো?

বুক ভরে যে শ্বাস নিতে চাও

জানো তো অক্সিজেনের পরিমাণটা কত?

এত যে কাছে আসতে চাও

কতটুকু সংযম আছে তোমার?

এত যে ভালোবাসতে চাও

তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি?


প্রেম
হুমায়ুন আজাদ

আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের? করি? হয়তো করি না? তুমি ভাবো

আমি আজ হয়তোবা আছি কোনো ঝলমলে অষ্টাদশী তরুণীর

সাথে; মেতে আছি ঠোঁটে, বুকে,শিহরণে; রোববার যাবো

অন্য কোনো তরুণীতে। আর আমি ভাবি অদ্বিতীয় তোমর শরীর

হয়তো পিষ্ট হচ্ছে কোনো শক্তিমান সুদর্শন দেবতার দ্বারা;

তোমার কন্ঠের স্বরে কে না কাপেঁ কয়েক সপ্তাহ? প্রথম তোমাকে

দেখেই কে না পড়ে থরোথরো প্রেমে? তোমাকে হয়তো তারা

পাঁচতারা, অথবা প্রাচীন ক্যাসেলে বাহুতে ও বুকে ক'রে রাখ।

হয়তো পাহাড়ে গেছো কারো সঙ্গে,-ভাবি-, উদ্যানপার্টিতে

কাটছে সন্ধ্যা; শেষে আলিঙ্গনে বেঁধে, বুকে ক'রে, কেউ নেবে ঘরে;

হয়তো ভাবছো তুমি নভেম্বরের এই মনোরম কুয়াশায় শীতে

কারো সঙ্গে আমি মত্ত মানবিক সবচেয়ে সুখকর জ্বরে।

আমাকে সন্দেহ ক'রে কষ্ট পাও? নিরন্তর? যে-রকম আমি

তোমাকে সন্দেহ ক'রে কাঁপি? দু:স্বপ্নে ঘুমহীন থাকি?

আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের? অবিশ্বাসে দিবা আর যামি

সন্দেহকেই প্রেমে পরিণত ক'রে বুক ভ'রে রাখি?


রান্নাঘরে নারীবাদী
হুমায়ুন আজাদ

তুমি এসেছিলে লিসবন আর আমি দূর ঢাকা থেকে;

দেখা হয়েছিলো গ্রান্টস হাউজের উষ্ণ রান্নাঘরে;

রাঁধছিলে তুমি পোর্ক ও পোটটো; আমার শুঁটকি রান্না দেখে

চেয়ে রয়েছিলে দুই নীল চোখ বিষ্ময়ে পুরো ভ'রে।


'হাই', হেসে বলেছিলে,'কোথা থেকে যেনো তুমি?'

'বাঙলাদেশ; আর 'তুমি?'-বলেছিলে, 'আমি পর্তুগাল।'

-'বাঙলাদেশ?' চিনতে পারো নি;-সাগর না মরুভূমি;

লজ্জা তোমার গন্ডদেশকে ক'রে তুলেছিলো আরো লাল।



তারপর আমরা অনেক রেঁধেছি;বুঝেছি রান্নায়ও আছে সুখ।

তুমি খুব সুখে খেয়েছো শুঁটকি, ভর্তা, বিরিয়ানি, মাছ, ভাত,

আমিও খেয়েছি পোর্ক ও পোটেটো; স্বাদে ভ'রে গেছে মুখ;

কথা ব'লে ব'লে বুঝতে পারি নি গভীর হয়েছে রাত।


''নারীবাদী আমি', বলেছিলে. 'খুবই ঘৃণা করি প্রেম আর বিয়ে,

প্রেম বাজে কথা; বিয়ে? ওহ গশ! খুবই নোংরা কাজ।'

'প্রেম বেশ লাগে', বলেছি আস্তে, 'কখনো বিবাহ নিয়ে

ভাবি নি যদিও; মনে হয় বিবাহের কোনো দরকার নেই আজ।'



চুমো খেতে খেতে ঘুমিয়েছি আমরা; বহু রাত গেছে সুখে,

আমাদের দেহে বেজেছে অর্গ্যান, ব্যাগপাইপ রাশিরাশি;

একরাতে দেখি কী যেনো জমেছে তোমার সুনীল চোখে,

আধোঘুমে ব'লে উঠেছিলে, 'প্রিয়, তোমাকে যে ভালোবাসি।'


কেঁপে উঠেছিলো বুক সেই রাতে; বেশি নয়, আট মাস পরে

বলেছিলে, 'চলো বিয়ে করি, আমার এখন বিয়ের ইচ্ছে ভারি।'

চুমো থেকে আমি পিছলে পড়েছি, ফিরেছি নিজের ঘরে;


'চলো বিয়ে করি, চলো বিয়ে করি', প্রতিটি চুমোর পরে;

এভাবেই , প্রিয়, একদিন হলো আমাদের চিরকাল ছাড়াছাড়ি।


শব্দচাষী
পংকজ কান্তি গোপ টিটু

শীতের রাত,

নিস্তব্দতার আগল ভেঙ্গে বেড়িয়ে পড়ে লোকটি |

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী,

জোনাকী আর অসংখ্য তারার মাঝে কোন তফাৎ খুঁজে পায় না সে |

নিরবতার রাজ্যে মাঝে মাঝে কড়া নাড়ে ট্রেনের ধসধস আওয়াজ ;

স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে অতিক্রম করে তাঁর চার দশক |

প্রতিনিয়ত লোকটি স্বপ্নের জাল বুনতো,

একটু স্বচ্ছলতা, প্রেম কিংবা জাগতিক সুখ কিছুই বাদ পড়েনি স্বপ্ন থেকে |

অথচ লোকটি এসবের কিছুই পায়নি |

পেয়েছে শুধু শব্দের সাথে শব্দ মেলানোর সাহস | 

'লোকটি শব্দচাষী' 

চারদশক ধরে অবিরত শব্দ চাষ করে গেছে ;

বিনিময়ে পেয়েছে করুণা, দরিদ্রতা | 

শীতের রাত,

কুয়াশা আর সময় সমান্তরালে বাড়ছে,

ঈশান কোনের বাঁশঝাড়ে কয়েকটি পেঁচার বিভৎস চিৎকার ;

বহুদুরে দেখা যায় কুণ্ডলী পাকানো আগুন; সম্ভবত গ্যাস ফিল্ডের-

অথচ লোকটি ভাবছে 'আলোর মিছিল' |

হঠাৎ করেই সমস্ত দরিদ্রতাকে ব্যঙ্গ করে বলে উঠেন তিনি 'আমি শব্দচাষী' 

আমার এক একটি শব্দের চারা এক সময় মহীরুহ  হবে |

উত্তর প্রজন্ম বেড়ে উঠবে তার সুশীতল ছায়ায় |

শীতের রাত,

সংসারের ব্যস্ত সব মানুষ জেগে উঠার আগেই লোকটি ঘরে ফেরে |


অমলকান্তি
          -নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 

অমলকান্তি আমার বন্ধু,

ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম । 

রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না,

শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে 

এমন অবাক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত যে,

দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের । 

আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল । 

অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায় নি । 

সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল । 

ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর, 

জাম আর জামরুলের পাতায় 

যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে । 

আমরা কেউ মাস্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল । 

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি । 

সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে । 

মাঝে-মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে ; 

চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, "উঠি তাহলে । "

আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি । 

আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে, 

অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত; 

যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, 

উকিল হলে তার এমন-কিছু ক্ষতি হত না । 

অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া । 

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি । 

সেই অমলকান্তি- রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে 

ভাবতে ভাবতে 

যে একদিন রোদ্দুর হয়ে যেতে চেয়েছিল । 

(অমলকান্তি-নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )


আত্মত্রাণ
 -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থণা-

বিপদে আমি না যেন করি ভয় । 

দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা, 

দুঃখে যেন করিতে পারি জয় । 

সহায় মোর না যদি জুটি     নিজের বল না যেন টুটে -

সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি,   লভিলে শুধু বঞ্চনা ,

নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয় ।। 

আমারে তুমি করিবে ত্রাণ,  এ নহে মোর প্রার্থণা-

          তরিতে পারি শকতি যেন রয় । 

আমার ভার লাঘব করি     নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,

          বহিতে পারি এমনি যেন হয় । 

নম্রশিরে সুখের দিনে         তোমারি মুখ লইব চিনে-

দুখের রাতে নিখিল ধরা     যেদিন করে বঞ্চনা 

          তোমারে যেন না করি সংশয় ।।


তোমার চোখ এত লাল কেন 
      -নির্মলেন্দু গুণ 

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই 

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক, 

শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য । 

বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত । 

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই 

কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে 

কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না, 

আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ 

নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে । 

আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক ;

আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,

পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরো একটা 

তেলে-ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না । 

এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি । 

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই 

কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরজা 

খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক । 

কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে 

জিজ্ঞেস করুক ; 'তোমার চোখ এত লাল কেন ?'

Post a Comment