রাষ্ট্র সংস্কার -কাজী জহিরুল ইসলাম । রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে প্রবন্ধ

রাষ্ট্র সংস্কার 
কাজী জহিরুল ইসলাম 

যে কোনো ঘটনার একটি "চালিকা নীতি" থাকে, ইংরেজিতে আমরা প্রায়শই এটাকে গাইডিং প্রিন্সিপাল বলে থাকি। বিপ্লবকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায় একটি স্বপ্ন। কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে আন্দোলনটি শুরু হলেও মানুষের মধ্যে বৃহৎ একটি স্বপ্ন সুপ্ত অবস্থায় ছিল, যা ক্রমশ এই আন্দোলনকে এবং এমন আরো বহু আন্দোলনকে ঘিরে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল। কিন্তু অন্য কোনো আন্দোলনে সেই স্বপ্নটি পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে তা পূর্ণতা পেয়েছে, অর্থাৎ একটি সফল বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কেন জুলাই বিপ্লব সফল হয়েছে আর সেই স্বপ্নটাই বা কী ছিল? এই বিষয় নিয়ে আজ কিছু কথা বলি।

প্রতিটি কাজের পেছনে যে একটি "চালিকা নীতি" থাকে তা আমরা কখনো টের পাই, কখনো টের পাই না। বাংলাদেশের মানুষের বুকের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে যে স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েই মরে যাচ্ছিল সেই স্বপ্নটি হচ্ছে "বৈষম্যহীন সমাজ" প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে মানুষ পূর্ণ স্বাধীন, কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে না, প্রত্যেকে তার মেধা ও পরিশ্রমের সঠিক মূল্য পাবে, কেউ কাউকে ঠকাবে না। কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ৫৩ বছরের বাংলাদেশে ঘটেনি। জুলাই আন্দোলনে আমাদের ছাত্ররা সেই স্বপ্নটিকেই আবার সামনে নিয়ে এসেছেন। এই স্বপ্নের তারা একটি "চালিকা নীতি" বা গাইডিং প্রিন্সিপাল ঠিক করেছেন, সেটি হচ্ছে "রাষ্ট্র সংস্কার"। বাংলাদেশের মানুষ হঠাৎ চমকে উঠেছে এই শব্দ দুটি শুনে। ঠিকই তো, নষ্ট হয়ে যাওয়া, ঢিলে হয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া রাষ্ট্রটিকে সংস্কার করতে পারলেই কেবল আমরা সেই কাঙ্খিত স্বপ্নের বেদীতে পৌঁছাতে পারবো।

যেহেতু তারা অসুস্থ রাজনীতির ঘোড়ায় চড়ে আন্দোলনের মাঠে আসেননি, মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছে। তারাই পারবে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে মেরামত করতে। তখন সকলের চাওয়া একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে। 

বিপ্লব কোনো প্রচলিত সংবিধানের আলোকে হয় না। ফ্যাসিস্টরা এমন একটি সংবিধান তৈরি করেন যেখানে বিপ্লব প্রবেশের কোনো রাস্তা থাকে না। সংবিধানের প্রাচীর দুমড়ে মুচড়ে দিয়েই বিপ্লব আসে। বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর নতুন সংবিধান রচিত হয়, যে সংবিধানে বিপ্লবের মূল স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়।

বিপ্লবের পরে গঠিত হয় বিপ্লবী সরকার কিন্তু জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা প্রচলিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আদলে তৈরি হওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন, আমিও হয়েছি। আমি এটিকে একটি 'মাইনর মিস্টেক' হিসেবেই দেখতে চাই এবং এই সরকারকেই বিপ্লবী সরকার মনে করি। এখন এই সরকারের কাজ হবে বিপ্লবী জনতার মূল যে দাবী, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা, তা নিশ্চিত করা।

ফ্যাসিস্ট সরকারের সকল অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। "বৈষম্য বিরোধী" বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বৈষম্যগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে। এই কাজের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের মত একটি শক্তিশালী  এবং কার্যকর "বৈষম্য দমন কমিশন" গঠন করতে হবে। পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে বৈষম্য বিরোধী কমিটি গঠনের কথা ড. পিনাকী ভট্টাচার্য বলেছেন, আমি মনে করি এটি একটি অসাধারণ প্রস্তাব। এই কাজটি করার জন্য সরকার যেন ছাত্র-জনতাকে উৎসাহিত করে এবং সহযোগিতা করে। এই কমিটির কাজ হবে সমাজের সকল স্তরের বৈষম্য শনাক্ত করা এবং তা নিরসনের জন্য "বৈষম্য দমন কমিশন" এর নজরে আনা। 

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৯ আগস্ট ২০২৪

Post a Comment

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.