সম্পাদনায়ঃ-মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
লেখার ধরণঃ প্রবন্ধ
যখনই কোনও ঘটনা আলোচনায় আসে তখন সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়া হয় নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তির দাবিও ওঠে নানা স্তর থেকে। কিন্তু কোনটা আসলে বেশি জরুরি?
নির্যাতনের শাস্তি নাকি নারীর সুরক্ষা?
বিপন্ন নারীরা বা তার পরিবার খুব কম ক্ষেত্রেই মামলা করতে চান। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, নির্যাতনের শিকার বেশিরভাগ মেয়ে ও তাদের পরিবার ঘটনা চেপে যান। ফলে গণমাধ্যমে যে-সব খবর আসে সেগুলো অনেক ঘটনার কয়েকটি মাত্র।
একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন নাজনীন খানম। প্রায়ই মনটা বিষণ্ন থাকে। বিদ্যালয়ের সহকর্মীরা বুঝতে পারেন; কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু বলতে পারেন না। বিষয়টি ব্যক্তিগত। কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে নাজনীন খানম একজন আইনজীবীর কাছে নিজের দুঃখের কথা জানান। স্বামী নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করে তাকে। চুন থেকে পান খসলেই কথা শুনতে হয়। তিরস্কার শুনতে হয়। প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন এমন অত্যাচার সইতে সইতে এখন আর নাজনীন মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারেন না। তার ভাষায়- ‘এর চেয়ে গায়ে হাত তুলে মারাও অনেক ভালো। এভাবে সবসময় মানসিক নির্যাতনের চেয়ে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করা যায়। মানসিক নির্যাতন সহ্য করা যায় না।’
নাজনীন খানমের মতো মানসিক নির্যাতনের শিকার অনেকেই, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলতে পারেন না। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী নারী থেকে শুরু করে স্বল্পশিক্ষিত নারীর অনেকেই শিকার হচ্ছেন মানসিক নির্যাতনের। কেউবা শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, দেবর, ভাশুর কিংবা পরিবারের অন্য সদস্য কর্তৃক। শারীরিক বা অর্থনৈতিক নির্যাতন আইন-আদালত কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রকাশ পেলেও মানসিক নির্যাতন তেমন একটা প্রকাশ পায় না। কারণ মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনের মতো চোখে দেখা যায় না। এক জরিপে এসেছে, স্বামীর দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ৮২ শতাংশ স্ত্রী।
এখন বিবেচ্য বিষয় মানসিক নির্যাতন বিষয়টা কেমন?
কোন ধরনের আচরণ মানসিক নির্যাতনের আওতাভুক্ত।
২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে মানসিক নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে।
এতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে- এমন কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের অন্য কোনো নারী বা শিশু সদস্য শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতির শিকার হলে একে পারিবারিক সহিংসতা বোঝানো হয়েছে।
মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভয় দেখানো বা এমন কোনো উক্তি করা, যার মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাকে মানসিক সহিংসতা অর্থে বোঝানো হয়েছে। এছাড়া হয়রানি, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তি গত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশে বাধা দেওয়া, চাকরি করতে বাধা দেওয়া, বাইরের মানুষের সামনে কথা শোনানো, পুরুষতান্ত্রিক আচরণ দিয়ে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা, সন্দেহ করা এগুলোও নির্যাতনের আওতা ভুক্ত।
এ আইনে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি হলে বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে আদালতের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করার বিধান রাখা হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলাও করা যায়; কিন্তু মামলা করার হার মাত্র ৩ শতাংশ।
মহামান্য হাইকোর্ট বলছে, গত এক দশক আগে আইনটি তৈরি হলেও অদ্যাবধি পর্যন্ত এ আইনের কোন মামলায় নিম্ন-আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে কেউই আসেনি। ফলে এ মামলার বিষয়ে উচ্চতর আদালতের কোনো সিদ্ধান্তই প্রকাশিত হয়নি। মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীদের এ আইনটি সম্পর্কে জানার ঘাটতি রয়েছে।
পাশাপাশি আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্যাতিত নারীর নিরাপত্তাও দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন আদালত। একজন নারী যখন স্বামী কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করছেন আবার একসাথে এক বাড়িতে থেকে সংসারও করতে চাচ্ছেন- তা রীতিমতো সাংঘর্ষিক। সেই সঙ্গে সহিংসতার শিকার নারীর পুনর্বাসন, সামাজিক সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কিত বিষয় আইনে সুস্পষ্ট নয়।
আবার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেই স্বামী তালাক দিয়ে দিচ্ছে। এ আইনে মামলার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তালাক প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।
একজন নারী যখন পিতা-মাতা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে এ আইনের অধীন আদালতে মামলা করছেন, তখন মাননীয় আদালত অভিযোগটি মোটেই সহজভাবে নিচ্ছেন না।
স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজন কর্তৃক নির্যাতিত নারীর মালামাল, সোনা-দানা ব্যবহার্য আসবাবপত্র আটকে রাখলে এ আইনের অধীন মামলা করে তা উদ্ধার করা যাবে।
১৫(১) এর উপধারা ৭-এ মালামাল উদ্ধারের কথা বলা থাকলেও জব্দকৃত মালামাল প্রাথমিক অবস্থায় কোথায় রাখা হবে- সে বিষয়ে আইনে কিছুই বলা হয়নি। ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা বলে থাকেন মালামাল রাখার জায়গা নেই। অনুরূপভাবে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত থানা পুলিশ বলে থাকেন তাদের মালখানায় জায়গা নেই।
এ আইনটি ফৌজদারি আদালতের এক্তিয়ার হলেও এটি দেওয়ানি প্রকৃতির আইন। আইনে বলা হয়েছে- নির্যাতিতের অভিযোগ প্রাপ্তির পর বিজ্ঞ আদালত ৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে শুনানির ব্যবস্থা করবেন এবং ৩ (তিন) দিনের মধ্যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সমন জারির বিশেষ ব্যবস্থা করবেন। সেই সাথে ভিকটিমকে সুরক্ষা প্রদানের আদেশ বিষয়ে শোকজ করবেন। এ আইনের ১৪ ধারা অনুযায়ী, বিজ্ঞ আদালত চাইলে সাথে সাথে ভিকটিমকে সুরক্ষার আদেশ বা ভিকটিমকে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আবার এ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রয়োজনে আদালত ভিকটিমকে নিরাপদে থাকতে প্রতিপক্ষকে ভিকটিমের আবাসস্থলে যেতে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত দিতে পারেন। সেই সাথে ১৬ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসার খরচ পর্যন্ত দিতে প্রতিপক্ষকে আদেশ দিতে পারেন।
বহু বছর আগে ফরাসি দার্শনিক অনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন- ‘আইন যদি সঠিক হয় এবং তার গ্রয়োগ যদি হয় যথাযথ, তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে।’
নারী অধিকার রক্ষার আইনগুলোর মধ্যে কিছু জটিলতা ও প্রায়োগিক দুর্বলতার কারণে দুই বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী; সবাই শিকার হচ্ছে সহিংসতার। মানসিকতার বিকৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মর্গে থাকা মৃত নারীর লাশও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষকের হাত থেকে।
সরকার নারীশিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও আইনের ফাঁক গলে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই শিক্ষা প্রক্রিয়া থেকে ঝরে পড়ছে তারা।
প্রয়োজনের তাগিদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০; অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন-২০০২; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন-২০০৯; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২; মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০; মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন-২০১১; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২
নারীর পক্ষে এরকম নানাবিধ আইন তৈরি করা হলেও ব্যবহারের অভাবে সেসব কার্যত ‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- প্রবাদের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধন ২০০৩)-এর অধীনে মামলাগুলোর তদন্ত সব সময় সঠিক সময়ে হচ্ছে না। বিচারকার্য ১৮০ দিনের মধ্যে সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও এতে সময় লাগছে ৩-৬ বছর পর্যন্ত। দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আসামির শাস্তি বিধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
১৯৯১ সাল থেকে এ দেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে নারী থাকলেও বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক উত্তরাধিকার আইনের কোনো বদল হয়নি। শুধু শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যাবে না। এ দেশে কাঠামোগতভাবে সমাজের পরতে-পরতে যত বৈষম্য বিরাজ করছে সেগুলো দূর করতে হবে। সেই লক্ষ্যে জরুরি উদ্যোগ নেয়া দরকার।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এমনকি ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচকেও উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের নারীদের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যাবসা এমনকি শ্রমের জায়গাতেও নারীদের উপস্থিতি সগৌরবে উল্লেখ করার মতোই।
কিন্তু কয়েকটা ব্যক্তির পদ-পদবির উন্নয়ন বা উপস্থিতি দিয়ে বাংলাদেশের নারীদের সামগ্রিক অবস্থা বিচার করা কতটুকু যৌক্তিক, সেটা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
নারীর জন্য আইন পাস করলেই নারীর উন্নয়ন ঘটে না। আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটা দেখা প্রয়োজন। নারীবান্ধব পুলিশ তৈরি করাই শেষ কথা নয়। সেই পুলিশ মানসিকভাবে কতটা নারী সহমর্মী, সেটাও দেখতে হবে। দেশের প্রতিটা জায়গায় নজর দিলে দেখব এসব উন্নয়নসূচক কেবল ‘অর্নামেন্টাল’, যা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে।
দেশে এতগুলো আইন থাকার পরেও বাংলাদেশের নারীরা আসলেই কেমন আছে?
বলবো- আমাদের মেয়েরা ভালো নেই। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে মেয়েদের পক্ষে এতগুলো আইন থাকার পরেও কেন বলছি এখানকার মেয়েরা ভালো নেই। কারণ আইন-আদালত সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে না, করতে পারে না।
সমাজের নানা অসংগতির বিচার আইনে-আদালতে হয় না। সবাই আইনও ঠিকঠাক জানেন না। জানলেও সবার ইচ্ছা বা সঙ্গতি থাকে না আইনানুযায়ী আদালতে যাওয়ার বা সব সময় ন্যায়বিচার পাওয়ারও সম্ভাবনা নিশ্চিত করা যায় না।
তথ্যসুত্রঃ
১/ দৈনিক সংবাদ(০৪ জানুয়ারি ২০২২)
২/দৈনিক প্রথম আলো(23 Dec 2015)
৩/বাংলা ট্রিবিউন( ২৬ অক্টোবর ২০১৬)
৪/প্রতিদের বাংলাদেশ(০৬ মার্চ ২০২৩)