প্রতিমা থেকে থিম
মঞ্জুশ্রী মণ্ডল
দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই শারদ উৎসব কে কেন্দ্র করে মানুষের আনন্দের শেষ থাকতো না। কয়েকটা পাড়া নিয়ে বা কয়েক টা গ্রাম নিয়ে অনেক সবাই থেকে মিটিং করে চাঁদা তুলে মহাসমারোহে উৎসব পালন করা হতো ,দুর্গা ঠাকুর আনা হতো। মূল বিষয় ছিল পূজা ।মূল বিষয় ছিল দুর্গা প্রতিমার আকর্ষণ। প্রতিমা কে কতটা সুন্দর করেছে কোন প্যান্ডেলে দুর্গা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে এই নিয়ে ছিল প্রতিযোগিতা।পূজা মানেই ছিল সবাই একসাথে মিলিত হওয়া ,আনন্দ করা। সামর্থমতো নিজের নিজের পোশাক পরা বাজি ফাটানো ইত্যাদি। সবাই একজায়গায় মিলিত হতো যে যেখানেই থাকতো।
আলাদা একটা আনন্দ ছিল। বিসর্জনের সময় সবাই আনন্দ করতো। যতদিন যায় বদলে যায় শারদ উৎসবের আচরণ। শুধুই যেন প্রতিযোগিতা। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা। তাছাড়া আগে এত ঘনঘন দুর্গা ঠাকুর আসতো না ঠিক যেন উৎসব তো উৎসব এর মত হত। কখন ও রেষারেষিছিল না। যতদিন যায় পাড়ায় পাড়ায় দুর্গা প্রতিমা আনা শুরু হয়। মানুষের উপর চাঁদার চাপ বাড়ে। স্ফূর্তিতে যেন অন্য রূপ ধারণ করে। মদ পূজার একটা বিশেষ অঙ্গ হয়ে গেছে। নানা রকম বাজি প্রদর্শনী করে টাকার অপচয় করা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। প্যান্ডেলের রংবাহারি রূপ দেখলে খুব আশ্চর্য লাগে। সরু গেট ওয়ালা এমন প্যান্ডেল সেখানে মানুষ খোলামেলাভাবে ঠাকুর দেখার সুযোগ পায় না ।ভিড় জমে যায় বয়স্ক মানুষরা সরাসরি মন খুলে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার সুযোগ পান না । তাঁরা হয়তো এরকম পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে না পারার কারণে ঠাকুর দেখতে পারেন না। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিযোগিতার কারণে মানুষের উপর এত চাঁদার চাপ পড়ে সেটা মানুষ সহ্য করতে পারেনা। প্রতিবাদ করতে গেলে 'দেখে নেব' গোছের কথা শুনতে হয়। সরকার থেকে পূজা কমিটি গুলিকে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা হয় সেগুলো মনে হয় অপচয়। এই টাকা অনেক ভালো কাজে লাগানো যায় ।অনেক দুস্থ মানুষের উপকারে লাগানো যায়।। পূজা মানে আপামর জনসাধারণের পূজা। সেখানে কোনো নেতা মন্ত্রীর দ্বারা ফিতে কেটে পূজা উদ্বোধন বড় বেমানান মনে হয়। আরো বেশি আশ্চর্য লাগে ছোটবেলায় জানতাম পূজা মানে চারদিনের। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী আমরা ক্লাসে রচনাতেও তাই লিখতাম। এখন দেখি পূজা চতুর্থী থেকে শুরু হয়ে যায়। ঠাকুর দেখার ঢল নামে মানুষের। দশমী পার হয়ে একাদশী দ্বাদশী তেও ঠাকুর থাকে। কেমন অদ্ভুত লাগে সবকিছু।কোন কোন প্যান্ডেলে দামি দামি গয়না দিয়ে ঠাকুরকে সাজানো হচ্ছে যেখানে পুলিশ পাহারা দিতে হচ্ছে।
খোলামেলা প্যান্ডেল না হওয়ার কারণে দর্শকদের ভিড় বেড়ে যায় সরাসরিভাবে ঠাকুর দেখাটা অসম্ভব হয়। আগে পূজা মানে জানতাম দুর্গা প্রতিমা র একরকম ই রূপ। ইদানিং দুর্গা ঠাকুরের কত রকমের বিকৃত রূপ দেখি। এটা যেন চিরাচরিত প্রথাকে লংঘন করা হয় মনে হয়। দর্শকদের কাছে প্রতিমা টা যতটা না দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় হয় প্যান্ডেলের থিম টাই যেন দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় বেশি মনে হয়। দর্শক ও ভক্তদের তফাৎ করা যায় না। এককথায় প্রতিমা থেকে হয়েছে থিমের বাহার ও আড়ম্বরপূর্ণ রূপান্তর । এর সাথে অর্থের অপচয় মনকে বিচলিত করে ও নাড়া দেয়।
প্রবন্ধ
দুর্গা পূজা ও মানবতাবাদ
মাজহার মান্নান
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টির সেরা হওয়াতে মানুষের দায়িত্ব অনেক বেশি। মানুষ তার সুন্দর সুন্দর কর্মের দ্বারা এ বিশ্বকে গড়ে তোলে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানুষের জীবনে বড় প্রভাব বিস্তার করে। দুর্গা পূজা একটি বড় ধর্মীয় উৎসব। এই পূজা হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের নিকট সবচেয়ে বড় পূজা। এই পূজার ধর্মীয় মূল্য যেমন অনেক, ঠিক তেমনি এর সাথে মানবতাবাদের একটি বিরাট যোগসুত্র রয়েছে। নারী শক্তির একটি বড় প্রতীক এটি। অন্যায়ের বিরুদ্ধ নারীর ভূমিকা যে কত শক্তিশালী হয় তা সহজে বোধগম্য। সবার মাঝে দারুণ একটি মেল বন্ধন তৈরি করে এই পূজা। সত্য ও সুন্দরের জয়গান করা হয় এবং সবার মাঝে সেটা ছড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় উৎসব মূল্যবোধ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। দুর্গা পূজার মাধ্যমে সার্বজনীন মানবতাবাদের প্রচার হয়। সবার মাঝে দারুণ এক সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে সবাই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং সবার মাঝে ভালোবাসার ও সমতার দর্শন সৃষ্টি হয়।
সবার মাঝে আনন্দ বয়ে আনে এই বড় ধর্মীয় উৎসবটি। সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের বিকাশ ঘটে এর মাধ্যমে। সামাজিক বন্ধন সৃষ্টিতে এর তাৎপর্য অপরিসীম। মানুষের মাঝে নৈতিক ও নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরিতে এর অবদান অনস্বীকার্য। ভেদাভেদ ভুলে মানবতাবাদের জয়গান গাওয়াই যে এর লক্ষ্য। সবার মাঝে সৃষ্টি হোক মায়া, দয়া ও ক্ষমা করার মানসিকতা। ''সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'' এই দর্শন যেন আমারা হৃদয়ে ধারণ করি।