মহানায়ক
রাবণ
রঞ্জন
রায়
আর্যপুত্র
রঘুপতি শ্রী রামচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে মহাকবি বাল্মীকি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রামায়ণ রচনা করেন। আনুমানিক এক হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে
রামায়ণ ভারতবর্ষে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পুরান কাহিনী নিয়ে রামায়ণ রচিত হলেও পরবর্তীতে এটা ভারতবর্ষে ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মেনে নেয়া হয়। পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় অনুদিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন ঋষি কবির পরশ পেয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আলোকে রামায়ণ নতুনভাবে সজ্জিত হতে থাকে। ডঃ সুনীতি কুমার
চট্টোপাধ্যায়ের মতে সম্ভবত অনার্যরাই এই গল্পের আদি
জন্মদাতা।
ভারতবর্ষের
ভূমিপুত্র অনার্যরা দ্রাবিড়দের বংশধর। অনার্যরা সম্ভবত আফ্রিকার আলপাইন মানব গোষ্ঠীর বংশধর। পৃথিবীর প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার
সমসাময়িক আমাদের ভারতের মহেঞ্জোদোরো ও হরপ্পার সভ্যতা।
বিদেশী আর্যরা এসে ভারতীয় এই প্রাচীন সভ্যতা
ধ্বংস করে। শেতাঙ্গ আর্যরা এদেশ দখল করার পর এদেশের ভূমি
সন্তানদের অনার্য, দস্যু,দানব,তস্কর,রাক্ষস বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করে। তাই পুরানকার ব্রাহ্মণ্যধর্মের আলোকে রামায়ণের নায়ক শ্রী রামচন্দ্রকে আর্যদের প্রতিনিধি হিসেবে ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে সৃষ্টি করেন। এজন্য রামায়ণের নায়ক শ্রী রামচন্দ্র সুপুরুষ,বীরত্বের মহিমায় ভাস্বর, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী,ধর্মপরায়ণ রাজপুত্র, জ্ঞানী,গুণী, সুসভ্য, শতশত সুশোভন বিশেষণে বিভূষিত। পক্ষান্তরে ভূমিপুত্র অনার্য দ্রাবিড়দের বংশধর হিসেবে রাবণ বিকলাঙ্গ (দশ মাথা),স্বৈরাচারী,
অসভ্য,রাক্ষস,দস্যু,দানব,নারী অপহরণকারী,কামুক ইত্যাদি শতশত দোষাত্মক বিশেষণে দুষ্ট। মনে হয় আর্য ঋষি
কবিদের আর্যপ্রীতির বিস্ময়কর তুলির আঁচড়ে রামচন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর অবতার হয়ে গেলেন।আর অন্যদিকে অনার্য বিদ্বেষের কারণে রাবণ হয়ে গেলেন হীনপ্রভ,অনুজ্জ্বল, মানুষখেকো বিকলাঙ্গ রাক্ষস। কিন্তু সত্যটা কি তাই?
রামায়ণ
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়লে ধরা পড়বে মনের অজান্তে ঋষি কবিদের কলমে রাবণের মহিমান্বিত কৌলিন্য,শৌর্যবীর্য,জ্ঞানবিজ্ঞানের বিপুল মহিমা ফুটে উঠেছে। আর্যরা আসার আগে ভারতে জাতিভেদ প্রথা ছিল না।আর্যদের চারটি বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ ছিলেন রামচন্দ্র।রাবণ ছিলেন প্রথম বর্ণের মানুষ, ব্রাহ্মণ বংশীয়। রাবণের প্রপিতামহ ছিলেন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মা। রাবণের পিতামহ ছিলেন স্বনামধন্য ঋষি পুলস্ত্য মুনি।রাবণের পিতা ছিলেন বিশ্রবা মুনি,পরম ব্রাহ্মণ। তাহলে বংশগতির দিক দিয়ে রাবণ ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রাহ্মণ ছিলেন।
রাবণের
রাজধানীকে বলা হয় স্বর্ণলঙ্কা।অতুলনীয় ঐশ্বর্যমণ্ডিত, শিল্পনিপুণ
কারুকার্যে সজ্জিত, হেমহর্ম অট্টালিকাতে পূর্ণ ছিল স্বর্ণপুরী। আলোক সজ্জায় সজ্জিত দীপাবলী তেজে বিকশিত হর্মগুলি ছিল নন্দিত। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যে মহামতি
রাবণের প্রাসাদের উজ্জ্বল বর্ণনা আমাদের চোখে পড়ে।
"উঠিলা
রাক্ষসপতি প্রাসাদ শিখরে
কনক
উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী।
চারিদিকে শোভিত কাঞ্চন
সৌধকিরীটিনী
লঙ্কা মনোহরা পুরী।"
নরখাদক
রাক্ষসের পুরী এত উন্নত হয়
কি করে অন্তত বিজ্ঞ জনের হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে। বাস্তবে পৃথিবীতে কোন মানুষের দশমুণ্ড দেখা যায় না।তাহলে রাবণের দশটি মাথা হয়ত কবি রূপক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। হয়ত কবি বুঝাতে চেয়েছেন রাবণ সাধারণ মানুষের চেয়ে দশগুণ মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। রাবণের পূর্বপুরুষদের কেউ মানুষের মাংস খেয়েছে এমন কোন চরণ রামায়ণের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে রাবণ কিভাবে নরখাদক রাক্ষস হয়ে গেলেন?আসলে এটা বোধগম্য নয়।
রাবণ
সহ তাঁর বংশধরদের বীর যোদ্ধারা সকলেই বিশেষভাবে বৈমানিক ছিলেন।পুষ্পক রথে চড়ে রাবণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন।রাবণপুত্র বীর মেঘনাদ রথে আরোহন করে মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করতেন।
রাবণ
একজন প্রাজ্ঞরাজনীতিবিদ,বিশিষ্ট বিজ্ঞানী,
কারিগরি
বিদ্যায় পারদর্শী একজন অসাধারণ মানুষ।
রাবণ
একজন অসাধারণ বীর্যবান রাজা।দেশপ্রেমের মহিমায় ভাস্বর বীরপুরুষ। স্নেহময় পিতা, পত্নীব্রত স্বামী। রামায়ণের পাতায় পাতায় রাবণের বীরত্বের কাহিনি যুগযুগ ধরে পাঠকহৃদয়কে ঋদ্ধ করবে।