প্রাক্তনী
সৌমেন
চ্যাটার্জি
________________
দেখুন তো সুবীরেশ বাবু আমন্ত্রণ পত্রের বয়ান টা ঠিক আছে কী না ।হাতে আর একটা মাস ।সুবীরেশ বাবু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের হাত থেকে বয়ান টা নিয়ে চেক করতে করতেই বললেন হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিক আছে মানস বাবু।
মানস
সরকার নীলরতন বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক ।নিজের কাজের ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হলেও সব কিছুই সহ
শিক্ষক দের সঙ্গে আলোচনা করে
নেন।সামনেই বিদ্যালয়ের সার্ধ শতবর্ষ পূর্তি উত্সব ।বিদ্যালয়ের সম্পাদক মহাশয় নজিরবিহীন
ভাবে অনুষ্ঠান টি পালন করতে
চান।প্রধান শিক্ষক মানসবাবু ও যথেষ্ট সংস্কৃতি
মনস্ক মানুষ ।অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসাবে উপস্থিত থাকবেন রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ।সমস্ত প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী দের ও আমন্ত্রণ জানান
হবে ।আমেরিকার বিখ্যাত প্রবাসী বাঙালি বৈঞ্জানিক কৌস্তভ সিংহ এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন
ছাত্র ।তাকেও ইতিমধ্যে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে ।এছাড়াও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদেরকেই আমন্ত্রণ করা হয়েছে ।চারদিন ব্যাপী চলবে এই অনুষ্ঠান।ছৌনাচ
থেকে শুরু করে বিজ্ঞান প্রদর্শনী সবকিছুই থাকছে সেখানে।খরচের জন্য সম্পাদক মহাশয় প্রধান শিক্ষক কে চিন্তা করতে
বারণ করেছেন ।অনুষ্ঠানের যেন কোনও ত্রুটি না হয়।শিক্ষামন্ত্রীর কাছে যেন বিদ্যালয়ের কোনও বদনাম না হয়।মানস বাবু
ও সুবীরেশ বাবু দিন রাত এক করে সবকিছু
বন্দোবস্ত করছেন ।
আয়োজন
প্রায় শেষের দিকে।এদিকে অনুষ্ঠানেরও বেশি দেরি নেই ।বিশাল মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল করা হয়েছে ।আমন্ত্রিত দের কার্ড ও পাঠিয়ে দেওয়া
হয়েছে ।বিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে যেখানে কান পাতা যায় এখন কেবল অনুষ্ঠান নিয়েই আলোচনা ।
দেখতে
দেখতে সেই প্রত্যাশিত দিন চলে এল।বিদ্যালয়ের সামনে বিশাল তোরণ বাঁধা হয়েছে ।একশ পঞ্চাশ জন ছাত্রী একশ
পঞ্চাশ টি শঙ্খে ফুঁ
দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করল।শিক্ষামন্ত্রী তখনও এসে উপস্থিত হননি ।তবে তিনি অনুষ্ঠান শুরু করে দিতে খবর দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বেন তিনি।আমেরিকার প্রবাসী বৈঞ্জানিক অবশ্য খবর দিয়ে দিয়েছেন কানাডায় তার এক সেমিনার আছে
তিনি আসতে পারবেন না।আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে উদ্বোধনী সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে একে একে অনুষ্ঠান এগোতে লাগল।প্রতিষ্ঠিত প্রাক্তন ছাত্র দের মধ্যে ইতিমধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন ওই জেলারই অতিরিক্ত জেলাশাসক
।তিনি বেশীক্ষন থাকতে পারবেন না মহকুমা শাষকের
সাথে তার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।সেই কারণেই তাকে আগে বক্তব্য রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ।বক্তব্য রেখে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরই কনভয় নিয়ে প্রবেশ করলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ।
করতালিতে
মুখরিত হয়ে উঠল গোটা স্কুল প্রাঙ্গণ ।সম্পাদক মহাশয় তাকে মঞ্চে নিয়ে গেলে তিনি নির্দিষ্ট আসনে বসলেন ।তার পাশে একদিকে প্রধান শিক্ষক এবং অন্য দিকে সম্পাদক মহাশয় ।অন্যান্য অতিথিরা যারা এসেছিলেন ইতিমধ্যে চলে গেছেন ।সকলেই তো কর্মব্যস্ত ।
এরপর
আমাদের বিদ্যালয়ের বার্ষিক পত্রিকার মলাট উন্মোচন করবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মাননীয়
পার্থসারথি দত্ত মহাশয় ।সঞ্চালকের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চম শ্রেণীর একটি ফুটফুটে ছাত্রী ট্রে তে প্যাকিং করা
একটি পত্রিকা এবং কাঁচিি নিয়ে মঞ্চে উঠল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পত্রিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করলেন।এরপর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মন্ত্রী
মহাশয়কে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে তিনি মাইক্রোফোন টা টেনে নিয়ে
বলতে শুরু করলেন ----মঞ্চে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকা গণ,সম্পাদক মহাশয়
এবং আমার স্নেহের ছাত্রছাত্রী বৃন্দ ।আজ খুবই আনন্দের দিন ।বিদ্যালয়ের সার্ধশত বর্ষ পূর্তি উৎসব।বিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন ছাত্র
ছাত্রী আজ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ
পদে দায়িত্ব প্রাপ্ত।তাদের অনেকেরই আজ এখানে হয়তো
উপস্থিত আছেন। আমি অনুরোধ করছি কেউ একজন এসে এই তাঁর সফলতার কাহিনী বর্তমান ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অনুপ্রেরণার আদর্শ হিসাবে তুলে ধরুন।
- সম্পাদক ও প্রধান শিক্ষক মহাশয় পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন ।দুজনেই তো বিলক্ষণ জানেন তেমন কোনও প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী এখন উপস্থিত নেই ।অনেকেই আসেননি ।যারা এসেছিলেন তারা সকলেই কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছেন ।মন্ত্রী মহাশয় মাইক হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন ।এমন সময় হঠাৎ হাঁটুর ওপরে ধুতি পড়া,চোখে মোটা কাঁচের চশমা পড়া এক বয়স্ক ভদ্রলোক চায়ের কেটলি হাতে মঞ্চে উঠলেন ।উনি একটু আগেই নীচে চা বিক্রি করছিলেন ।একজন চা বিক্রেতা কে মঞ্চে উঠতে দেখে সম্পাদক মহাশয় ভ্রু কোঁচকালেন।হেড মাস্টার মশাই তো হেই হেই করে তেড়ে গিয়ে বলেই ফেললেন আপনি নীচেই চা বিক্রি করুন না মঞ্চে ওঠার অনুমতি আপনাকে কে দিয়েছে ।ঐ বৃদ্ধ চা ওয়ালা কোন কথাই কর্ণপাত না করে কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কেটলি টা মন্ত্রী মশাই এর সামনে টেবিলে রেখে মাইক্রোফোন টা হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলেন ।আমি এই বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র ।ষাট বছর আগে আমি বিদ্যালয় থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করি।তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন ভুবন বিহারী ঘোষাল ।এই বিদ্যালয়ে আমি বেশ কিছুদিন ইংরেজি শিক্ষক না থাকার জন্য শিক্ষকতাও করেছি।পরবর্তী কালে রেলের ডিভিশনাল ম্যানেজার পদে চাকরি ও পাই।কিন্তু পোস্টিং হয় ব্যাঙ্গালোরে।বাবা তখন অসুস্থ ।চার ভাই এর দায়িত্ব আমার ওপর ।একদিকে সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি অন্যদিকে রূঢ় বাস্তব ।বাস্তব টাকেই মেনে নিতে হল।স্কুলের সামনেই চায়ের দোকান দিলাম।হ্যাঁ আমি একজন চা ওয়ালা ।এটাই আমার পরিচয় ।আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত নই।তবে আমি এই স্কুলেরই একজন প্রাক্তন ছাত্র এবং সৎপথে উপার্জন করি।প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে মাননীয় মন্ত্রী মশাই এর অনুরোধে কিছু বললাম।ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা প্রার্থী ।
অন্যান্য
শিক্ষকরা ততক্ষণে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন ।তাঁরাও যে টিফিন টাইমে
এই ভদ্রলোকের দোকান থেকেই চা খান এবং
তাঁদের এঁটো কাপ গুলি ঐ ভদ্রলোক নিজে
হাতেই ধোয়াধোয়ি করেন ।
অনুষ্ঠান
ততক্ষণে শেষ হয়েছে ।মন্ত্রী মশাই ফেরার পথে ঐ বৃদ্ধ ভদ্রলোকের
দোকান থেকে এক কাপ চা
খেয়ে বাড়ি ফিরলেন ।
(সমাপ্ত )