অতুল প্রসাদ সেন
কবি
অতুল প্রসাদ সেন : দাম্পত্য জীবন
সৈয়দ সওকাত হোসেন
( পর্ব - ১ )
১৮৯০
সালের ঘটনা , প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা শেষ করে তিনি সোজা চলে গেছিলেন বিলেতে । লন্ডনে মিডিল
টেম্পলে শুরু করলেন ব্যরিস্টারি পড়া । একদিন সেখানেই
ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা । বড়ো মামা
কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত সপরিবারে বিলেতে আসলেন , বড়ো মামার মেয়ে ছিলেন হেম কুসুম । হেম কুসুম
সুন্দরী , সুগায়িকা , বেহালাটাও সুন্দর বাজাতে পারেন । তাঁর বেহালা
শুনতে শুনতে ব্যারিস্টারি পড়ুয়া সেই দাদাটি তন্ময় হয়ে পড়তেন , আবার কখনও কখনও মায়ের জন্য যখন মন খারাপ হত
তখন সেই হেম কুসুমই পাশে এসে সান্তনা দিতেন । আর এভাবেই
শুরু হলো ভালোলাগা , ক্রমশঃ দানা বেঁধে উঠলো গভীর এক বন্ধুত্ব , গভীর
এক ঘনিষ্ঠতা , যাকে বলা যায় ভাই বোনের এক নিষিদ্ধ সম্পর্ক
। ব্যারিস্টার পড়ুয়া সেই ছাত্রটি আর কেউ নন
, তিনি হলেন বাংলার সঙ্গীত জগতের বিশিষ্ট গীতিকার , সুরকার , গায়ক সংগীতজ্ঞ কবি অতুল প্রসাদ সেন ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালি যে চারজন কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ পেয়েছিল তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , দ্বিজেন্দ্রলাল রায় , রজনীকান্ত সেন এবং অতুল প্রসাদ সেন । কাজী নজরুল ইসলাম এসেছেন আরও অনেক পরে । তা গানের সংখ্যার বিচারে অতুল প্রসাদ সেন তাঁর সমসাময়িক তিন সংগীতজ্ঞ-র থেকে বেশ পিছিয়ে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেখানে লিখেছেন প্রায় দু'হাজার গান , দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন প্রায় পাঁচশটি গান এবং রজনীকান্ত সেন প্রায় দুশ নব্বইটি গান , সেখানে অতুলপ্রসাদ লেখছেন দুশ ছয়টি গান । কিন্তু তিনি গানের মধ্যে , গানের স্বকীয় তাল লয় অক্ষুন্ন রেখে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনায় কিংবা তার মিশেলে গানের মধ্যে যে অন্তর্লীন মায়া , অন্তর্লীন মুগ্ধতা তৈরি করে ছিলেন , তাঁর সেই অতুলনীয় কাজের জন্য তিনি হয়ে রইলেন সবার থেকে আলাদা । হয়ে রইলেন বাংলা সংগীত জগতের ইতিহাসে মৌলিক প্রতিভায় ভাস্বর এক নক্ষত্র ।
আমার ধারণা তাঁর গান শোনেন নি এমন একজন
বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার । তাঁকে নিয়ে
লিখতে গিয়ে তাঁর বিখ্যাত গানগুলি বারবার মনে পড়ে যায় , "উঠো গো ভারত লক্ষী"
, "বলো বলো বলো সবে শত বীণা বেনু
রবে" অথবা "হও ধর্মেতে ধীর,
হও কর্মেতে বীর" কিংবা আত্যশর্যের সেই গান "মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা
ভাষা" । বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ
দিলীপ কুমার রায় তাঁর সম্পর্কে একবার বলেছিলেন , জীবনে গভীর বেদনা , গভীর যন্ত্রণা ভালো , বেশ ভালো , যদি সেই বেদনা আঁধারে তারার মত ফুল ফোটাতে
পারে । এ কথা
থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বোঝা যায় যে অতুল প্রসাদ
সেন দেশাত্মোবোধক গান অথবা ভক্তিরসের গান , প্রেমের গান তিনি লিখলেও গানের আধার আসলে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত বেদনা , ব্যাক্তিগত যন্ত্রণা ।
এখন প্রশ্ন হলো কি ছিল সেই
বেদনা, কি সেই যন্ত্রণা
? যা গভীর অন্ধকারে নক্ষত্রের মত অজস্র গানের
ফুল ফুটিয়ে ছিল । এই নিয়েই
তাঁর সেই গল্প তুলে ধরছি । অতুল প্রসাদ
সেন তাঁর জীবনে প্রথম আঘাতটি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে । মায়ের নাম
ছিল হেমন্ত শশী দেবী । প্রথম স্বামী
রামপ্রসাদ সেন , যিনি ছিলেন অতুল প্রসাদ সেনের বাবা , তাঁর অকাল মৃত্যুর পর হেমন্ত শশী
দেবী বাপের বাড়িতেই থাকতেন । একদিন ছেলেমেয়েদের
বাপের বাড়িতে রেখে কিছু সময়ের জন্য তিনি বড়ো ভাই কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্তের কাছে যান । সেই যে
গেলেন আর ফিরলেন না
। কিছুদিন পর খবরে জানাজানি
হলো যে ৪৩ বছর
বয়স্ক বিধবা হেমন্ত শশী দেবী যিনি চার ছেলেমেয়ের মা , তিনি বিয়ে করেছেন ৪৯ বছর বয়স্ক
ব্রাহ্মণেতা দূর্গামোহন দাসকে যিনি ছয় সন্তানের বাবা । বিয়েটা হয়েছিল
অত্যন্ত সংগোপনে, কিন্তু তা সত্বেও সমাজে
চারিদিকে ছি ছি পড়ে
গেল । অতুল প্রসাদ
সেন গভীর আঘাত পেয়েছিলেন । তীব্র যন্ত্রণায়
, অভিমানে মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন
করেছিলেন । সত্যিকথা বলতে
গেলে যৌবনের প্রারম্ভে মায়ের কাছ থেকে তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন
, তা সারাজীবনেও তিনি ভুলতে পারেন নি ।
১৮৯৫ সালে বিলেত থেকে ফিরলেন
ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেন । বিলেতেই বড়ো
মামার মেয়ে হেম কুসুমের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল তাঁর প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা । মনের গভীরে
এক ভাবনা নিয়ে কোলকাতা সার্কুলার রোডে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে উকালতি করবেন তারজন্য অফিস খুললেন । একদিন কোনো
ভূমিকা না করেই বাড়িতে
আচমকা তিনি ঘোষণা করলেন তিনি হেম কুসুমকে বিয়ে করবেন । আত্মীয় পরিজন,
পাড়া প্রতিবেশী, মা , সৎ বাবা সবাই
শুনে শিউরে উঠলেন, মামাতো পিসতুতো ভাইবোন এই বিয়ে হয়
কি করে, এতো ঘোর অনাচার । বাধার শক্ত
প্রাচীর তৈরি করলেন অতুল প্রসাদ সেনের মা হেমন্ত শশী
দেবী । শোনা যায়
অতুল প্রসাদ সেনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের
পেছনে মায়ের প্রতি তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা নাকি কাজ করেছিল ।
যাইহোক বিয়ের ব্যাপারে একদিকে যেমন অতুল প্রসাদ সেন ছিলেন তুমুল নাছোড় বান্দা , তেমনই অন্যদিকে মামাতো বোন হেম কুসুম তিনিও ছিলেন পৃথিবীর যেকোনো বাধাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত । এতো বছর
ধরে দু'টো মনের
প্রেমের যে ফল্গু ধারা
প্রবাহিত হয়েছে তার স্বীকৃতি চাইছে সরবে । কিন্তু কে
দেবে এই বিষম প্রেমের
স্বীকৃতি ? পারিবারিক
বা সামাজিক ক্ষেত্রে শুধু বাধা নয় , বাধা তো আইনেও ।
ব্রিটিশ বা হিন্দু আইনে
এ দেশে এই বিয়ে কখনই
সিদ্ধ নয় । তাহলে উপায়
? দিশেহারা , উদভ্রান্ত অতুল প্রসাদ সেনকে অবশেষে আশার আলো দেখালেন তাঁরই সিনিয়ার সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ যিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে যাও , ওখানকার আইনে ভাইবোনের বিয়ে হয় ।
অতুল
প্রসাদ সেন আবার বিলেত যাত্রা করলেন , এবার সঙ্গে হেম কুসুম । স্কটল্যান্ডের গ্রেট
নাগরীন , এই গ্রামে তাঁদের
বিবাহ পর্ব সাঙ্গো হল । বিয়ের
পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা দেশে আর কখনও ফিরে
যাবেন না । কিন্তু
বাস্তব বড়ো কঠিন । লন্ডন শহরে
অতুল প্রসাদ সেনের প্র্যাক্টিস জমলো না , অর্থসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হলো । এরইমধ্যে ১৯০২
সালে যমজ দুই ছেলে দিলীপ কুমার ও নীলিপ কুমারের
মধ্যে নীলিপ কুমারের অকাল মৃত্যু ঘটলো । ছেলের মৃত্যুতে
অতুল প্রসাদ সেন একদম ভেঙে পড়লেন একেবারে । অবশেষে
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাধ্য হয়ে কোলকাতা ফিরলেন ।
কোলকাতায়
ফিরলেন বটে , তবে এখানে চারিদিকে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, নিন্দা আর সমালোচনা ।
বিরক্ত বিধ্বস্ত অতুল প্রসাদ সেন এবার কোলকাতা ছাড়লেন সপরিবারে । তিনি সপরিবারে
চলে গেলেন লখনৌ শহরে ।
হ্যাঁ , একথা সত্যি যে লখনৌ শহরে
তাঁর পশার জমে উঠেছিল , শহরের কেশরবাগ অঞ্চলে সেযুগের তেত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে রাজপ্রাসাদের মত একটা বাড়ি
তিনি তৈরি করেছিলেন । অল্পসময়ের মধ্যেই
তিনি বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন । অসাধারণ সব
দেশাত্মবোধক গান , ভক্তিরসের গান , প্রেমের গান লিখে সুর দিয়ে বাংলা গানের সম্ভারে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূর্ছনা প্রবেশ করিয়ে নতুন বাংলা গানের ধারা তৈরি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শহরের বিদ্বোজনের মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
।
এ সবই সত্য
, কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও , সামাজিকভাবে বিপুল প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তিনি কোনোদিন মানসিক শান্তি স্থিরতা অর্জন করতে পারেন নি । অপ্রত্যাশিত
এক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন , এর মূল কারণই
ছিল ক্ষত বিক্ষত তাঁর দাম্পত্য জীবন । সামাজিক পারিবারিক
সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে তিনি যাঁকে বিয়ে করেছিলেন , সেই হেম কুসুমের সাথে সুখের স্বছন্দের জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো
না । এই অশান্তির
মূল কেন্দ্রে ছিলেন তাঁরই মা হেমন্ত শশী
দেবী । মায়ের দ্বিতীয়
স্বামী দুর্গা মোহন দাসের মৃত্যু হলে অতুল প্রসাদ সেন তাঁর মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন লখনৌতে । আর তখন
থেকেই জ্বলে উঠেছিল সাংসারিক অশান্তির লেলিহান শিখা ।
হেম কুসুম , তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা । বিয়েকে কেন্দ্র
করে আত্মীয়স্বজনদের যে আচরণ , বিশেষ
করে হেমন্ত শশী দেবীর যে শক্ত বাধা
, সমালোচনা , তিরস্কার তা কখনওই তিনি
ভুলতে পারেন নি । এমন
শাশুড়ির সঙ্গে কোনরকম তিনি সম্পর্ক রাখতে রাজি ছিলেন না । ফলে
অচিরেই শুরু হয়েছিল শাশুড়ি পুত্রবধূর ভয়ংকর সংঘাত । বলা বাহুল্য
অতুল প্রসাদ সেন সেই সংঘাতের কোনো কূলকিনারা করতে পারেন নি । মাকে
যেমন তিনি শান্ত করতে পারেন নি তেমনি স্ত্রীকেও
সংযত করতে পারেন নি , মাঝখান থেকে তিনি বারবার হয়েছিলেন যন্ত্রণাবিদ্ধ , গভীরভাবে বেদনাবিদ্ধ । অবশেষে স্ত্রী
বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে লখনৌ শহরে আলাদা বাড়ি ভাড়া করলেন । একই শহরে
তাঁরা রয়েছেন , কিন্তু আলাদা আলাদা বাড়িতে । সে এক
দুসহ বিচ্ছেদের জীবন । অথচ তাঁদের
মধ্যে ছিল ভালোবাসার পূর্ন পাত্র , এমনও হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বাসর কিংবা গানের আসর , স্ত্রী হেম কুসুম , তিনি এসে সমস্ত আয়োজন করেছেন হাসিমুখে নিজের হাতে , আবার অনুষ্ঠান শেষে ফিরে গেছেন তাঁর সেই ভাড়া বাড়িতেই । আবার কখনও
স্বামী অসুস্থ হয়েছেন স্ত্রী ছুটে এসেছেন , সেবা করেছেন , আবার স্ত্রী অসুস্থ হয়েছেন , স্বামী ছুটে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন । কিন্তু সেসবই
ছিল সাময়িক , আসলে দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কে যে চিড় ধরেছিল
তা কখনওই আর জোড়া লাগে
নি । বিচ্ছেদের সেই
সুদীর্ঘ কালে স্ত্রী হেম কুসুমের কণ্ঠে ঠাঁয় পেতো স্বামীর অতুল প্রসাদের গান , আর স্বামী তিনিও
স্ত্রীর বিরহে বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন চোখের জলে , গান লিখে , গানে সুর দিয়ে , গান গেয়ে । মনে পড়ে
যায় তাঁর সেই বিখ্যাত গানটির কথা - ' বন্ধুয়া নিন্দ নাহি আঁখি পাতে , আমিও একাকী তুমিও একাকী আজই বাদল রাতে ...' ।
জীবনের অপরাহ্নে ক্ষত বিক্ষত দাম্পত্য জীবনের যন্ত্রণায় অতুল প্রসাদ সেনের জীবনীশক্তির ক্ষয় হয়েছিল । একেবারে শেষের
দিকে অসুস্থ শরীরে তিনি হাওয়া বদলের জন্য পুরী গিয়েছিলেন । পুরী থেকে
কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেও আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন । লখনৌর বাড়িতে
একে একে সবাই তাঁকে দেখতে আসতেন । কিন্তু স্ত্রী
হেম কুসুম , তিনি আসলেন না । অবশেষে
সমস্ত অভিমান ভুলে হেম কুসুম যখন আসলেন , তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । তখন এই
পৃথিবীতে তিনি আর নেই , পড়েছিল
তাঁর নিষ্প্রাণ নিথর দেহ ।
১৯৩৪ সালে ২৬ শে আগস্ট
৬৩ বছর বয়সে অতুল প্রসাদ সেন গভীর রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন । তাঁর মৃত্যুর
সাথে তাঁর দীর্ঘ দুঃখ যন্ত্রনার সমাপ্তি ঘটল । যে দুঃখ
যে যন্ত্রনা তাঁকে সৃষ্টির পথে চালিত করেছিল আজীবন ।
( সমাপ্ত )